আমাদের জন্য শিক্ষণীয় | খন্দকের (আহজাবের) যুদ্ধ-৩, ইসলাম কোনো দুঃসংবাদ সবাইকে জানিয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করাকে সমর্থন করে না। নবিজি (সা) বনু কুরায়জার বিশ্বাসঘাতকতার খবর ছড়াতে আনসার নেতাদের নিষেধ করেছিলেন। অথচ আমাদের সময়ের হাইপার- ইনফ্লেটেড’ মিডিয়া তেমন কাজই করে থাকে, তারা যে কোনো সহিংসতার তথ্য আরও মারাত্মকভাবে উপস্থাপন করে, যে কোনো অশ্লীল বিষয় আরও রসালো করে বর্ণনা করে, যে কোনো গুজবকে আরও বড় বানিয়ে তার ডালপালা বিস্তারে ভূমিকা রাখে । এ প্রবণতা সমাজের জন্য ক্ষতিকর।
সহিহ বুখারির একটি বর্ণনা থেকে আমরা জানি, খলিফা উমর (রা) একটি ঘটনার খবর জনসমক্ষে বলতে চেয়েছিলেন। তখন কয়েকজন প্রবীণ সাহাবি তাঁকে বলেন, “এত লোকের মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা করবেন না। এখানে ভালো ও মন্দ সব রকমের লোকই আছে। আমরা মদিনায় ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। সেখানে গিয়ে ভেবেচিন্তে তারপর খবরটি সবাইকে জানান।”
আমাদের জন্য শিক্ষণীয় | খন্দকের (আহজাবের) যুদ্ধ-৩ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

কুরাইশ
কুরাইশরা মদিনার কাছে পৌঁছার পর পরিখাটি দেখতে পেয়ে কী করা উচিত বুঝে উঠতে পারছিল না। তবে তারা এটুকু বুঝেছিল যে, এত বড় দলবল নিয়ে এই পথে সরাসরি মদিনায় প্রবেশ করা সম্ভব হবে না। তাই তারা সেখানে শিবির স্থাপন করে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে জন্য তাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য সামগ্ৰী মজুত ছিল। তারা নিশ্চিত ছিল যে শেষ পর্যন্ত তারাই জিতবে, এখন শুধু অপেক্ষার পালা ।
ছোটখাটো সংঘর্ষ
খন্দকের যুদ্ধের একটি উল্লেখযোগ্য দিক, মুসলিমদের বিপক্ষে শত্রুপক্ষের সবচেয়ে বড় লোকবলের সমাহার হলেও অন্য প্রধান যুদ্ধগুলোর তুলনায় এই যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে কম। এটিকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ রহমতই বলতে হবে। আল্লাহ বলেছেন: “হে মুমিনগণ! তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য কর, তাহলে তিনিও তোমাদের সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা দৃঢ় করবেন।” [সুরা মুহাম্মদ, ৪৭:৭] তবে এই যুদ্ধে বেশ কয়েকটি ছোটখাটো সংঘাতের ঘটনা ঘটেছিল: ১. আমর ইবনে আবদ উদের নেতৃত্বে আহজাবের পাঁচজনের একটি ছোট্ট দল পরিখা পার হয়ে মুসলিমদের দিকে চলে এসেছিল। সেই মুহূর্তে সেখানে মুসলিমদের কেউ ছিল না। আমর ছিল সেই কুরাইশ প্রবীণদের একজন যারা যুদ্ধের সময়ে হিংস্রতার জন্য পরিচিত ছিল। আহজাবের যুদ্ধে সে শত্রুপক্ষকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে একটি লাল পাগড়ি পরে ছিল।
আমর পাঁচজনের দল নিয়ে পরিখা পার হতেই মুসলিমদের একটি দল তাদের দেখে সেখানে ছুটে গেল। আমর তাদের বলল, “কে আমার সাথে লড়াই করবে?” আলি ইবনে আবি তালিব (রা) বললেন, “আমি লড়াই করব।” নবিজি (সা) আলিকে বললেন, “হে আলি, এ তো আমর ইবনে আবদ উদ । তার সঙ্গে বয়স্ক কেউ লড়াই করুক ।” কিন্তু সাহাবিদের কেউ আমরের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এগিয়ে এলেন না।
আমর দ্বিতীয়বার বলল, “কে আমার সঙ্গে লড়াই করবে?” আলি (রা) দ্বিতীয়বার বললেন, “আমাকে যেতে দিন।” নবিজি (সা) আবারও আলিকে বললেন, “সে আমর ইবনে আবদ উদ।” আমর তৃতীয়বারের মতো বলে উঠল, “কে আমার সাথে লড়াই করবে?” নবিজি (সা) আবারও আলিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “সে আমর ইবনে আবদ উদ।” আলি (রা) এবার বললেন, “হোক না সে আমর ইবনে আবদ উদ!” নবিজি (সা) আলির মধ্যে এত উৎসাহ দেখে তাঁকে লড়াইয়ের অনুমতি দিলেন।

আমর আলিকে (রা) দেখিয়ে বলল, “এ (এই ছেলেটি) কে?” প্রশ্ন শুনে আলি (রা) নিজের পরিচয় দিলেন। আমর আশা করেছিল, তার মতো বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে থেকে হয়তো কেউ আসবে। আলির বয়স তখন বিশের কোঠায়, আমরের চোখে তিনি তখনও একটি বাচ্চা ছেলে। তাই সে বলল, “ও হে ছোট্ট শিশু, ফিরে যাও; অন্য কাউকে পাঠাও। আমি কোনো বাচ্চা ছেলের সঙ্গে লড়তে চাই না। তোমাকে হত্যা করার বা তোমার ক্ষতি করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।”
আলি (রা) বললেন, “কিন্তু আপনাকে হত্যা করার ইচ্ছা আমার আছে।” এই কথোপথনের পর আমর ও আলি নিজ নিজ ঘোড়া নিয়ে মাঠের দিকে অগ্রসর হলেন। ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন, ঘোড়াগুলো এত ধুলা উড়াচ্ছিল যে, সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। কিছুক্ষণ পর ধুলার ভেতর থেকে আলির (রা) কণ্ঠে তাকবিরের ধ্বনি শোনা গেল। অর্থাৎ বোঝা গেল, লড়াইয়ে তিনি জয়ী হয়েছেন।
অন্য একটি বর্ণনা অনুসারে, আলি (রা) ও আমর উভয়েই এক সময় নিজ নিজ ঘোড়া থেকে নেমে পড়েছিলেন। আমর তার তলোয়ার দিয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে আলির মাথায় আঘাত করার চেষ্টা করে। আলি ক্ষিপ্র গতিতে তাঁর বর্ম দিয়ে আঘাতটি ঠেকানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আমরের আঘাত এতই জোরালো ছিল যে, আলির (রা) বর্ম ভেঙে যায়। ঠিক তখনই তিনি আরেক হাত দিয়ে আমরের ঘাড়ে তলোয়ার চালিয়ে তাকে শেষ করে দেন।
২. আহজাবের পক্ষ থেকে নওফাল ইবনে আবদিল্লাহ নামে আরেক ব্যক্তি পরিখা পার করে এসেছিল। জুবায়ের ইবনে আওয়াম তড়িৎ আক্রমণ করে নওফালের দেহকে আক্ষরিক অর্থেই দুই টুকরা করে ফেলেন। উল্লেখ্য, যুদ্ধের পরে কেউ কেউ জুবায়েরকে বলেছিল, “তোমার তলোয়ার কী বিস্ময়কর।” জুবায়েরের জবাব ছিল, “না, ব্যাপারটা তলোয়ারের নয়, ব্যাপার আমার বাহুর।”

নওফালের দ্বিখণ্ডিত মৃতদেহ রোদে মাটিতে পড়ে ছিল। কুরাইশরা এই দৃশ্য দেখে পরিখার অপর পাশ থেকে চিৎকার করে বলল, “লাশটা আমাদের কিনে নিতে দাও, যাতে আমরা তাকে কবর দিতে পারি।” নবিজি (সা) তাদের বললেন, “এই লাশ অপবিত্র। তোমাদের টাকার কোনো প্রয়োজন নেই আমাদের। আমরা লাশ বেচাকেনা করি না। তোমরা এসে লাশ নিয়ে যাও এবং কবর দাও।” আমরা বদরের যুদ্ধেও দেখেছি, নবিজি (সা) প্রতিটি মৃতদেহ মর্যাদার সঙ্গে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন, এমনকি যারা যুদ্ধের ময়দানে মুসলিমদের হত্যা করার চেষ্টা করেছিল তাদেরও।
৩. কুরাইশদের পক্ষের খালিদ ইবনে ওয়ালিদও পরিখা পার হয়ে এসেছিল এবং তলোয়ার দিয়ে লড়াইও করেছিল, কিন্তু তাতে কেউ মারা যায়নি। অবশেষে সে ফিরে যায়।
৪. ইকরিমা ইবনে আবি জেহেলও পরিখা পার হয়ে এসেছিল। তবে সেও মুসলিমদের জন্য বড় কোনো ক্ষতির কারণ ঘটাতে পারেনি। অবশেষে সেও ফিরে চলে যায়। এই যুদ্ধে আহজাবের পক্ষের ৪-৫ জন নিহত হয়। আর মুসলিমদের পক্ষের ৬-৭ জন শহিদ হন।
আরও পড়ুনঃ
