হাফসা বিনতে উমর (রা) | মহানবি মুহাম্মদের (সা) বিয়ে, নবিজির (সা) চতুর্থ স্ত্রী ছিলেন হাফসা বিনতে উমর (রা)। তাঁদের বিয়ে হয়েছিল ৪র্থ হিজরিতে, আমরা এখন সিরাহের আলোচনার যে পর্যায়ে আছি সেই সময়ে ।
সম্ভবত নবুয়তের পাঁচ বছর আগে হাফসার জন্ম হয়েছিল। আনুমানিক ১২ বছর বয়সে খুনায়েস ইবনে হুদায়ফার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। খুনায়েস প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের একজন। বিয়ের পর তাঁরা দুজন আবিসিনিয়ায় পাড়ি জমান। খুনায়েস সম্পর্কে আমাদের বেশি কিছু জানা নেই। আমরা শুধু জানি, তিনি বদর ও ওহুদের যুদ্ধে অংশ নেওয়া একজন সাহাবি ছিলেন। ওহুদের যুদ্ধে আহত হওয়ার পরে সৃষ্ট ক্ষত থেকে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
হাফসা বিনতে উমর (রা) | মহানবি মুহাম্মদের (সা) বিয়ে | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

স্বামীর এই অকালমৃত্যুতে হাফসা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। একাকিত্ব তাঁর যন্ত্রণা আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। সে সময় তাঁর বয়স ছিল ১৯ বা ২০ বছর। পিতা উমরও (রা) কন্যার এই কষ্টকর অবস্থা দেখে মনোকষ্টে ছিলেন। তাই হাফসার ইদ্দতকাল শেষ হওয়ার পর উমর (রা) উসমান ইবনে আফফানের (রা) কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “হাফসার ব্যাপারে আপনার মত কী?” তখকার দিনে এরকমটাই হতো। পাত্রীর অভিভাবক সম্ভাব্য পাত্রের কাছে গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতেন। আবার এর বিপরীতটাও হতো। পাত্র নিজেই পাত্রীর অভিভাবকের কাছে গিয়ে বিয়ে করার আগ্রহ প্রকাশ করতেন ।
উসমানের (রা) প্রথম স্ত্রী নবিজির (সা) কন্যা রুকাইয়া বদরের যুদ্ধের পরপরই ইন্তেকাল করেন। উসমান (রা) একটু লাজুক প্রকৃতির হওয়ার কারণে তখনও বিয়ে করেননি। উমরের (রা) প্রস্তাবে উসমান (রা) কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “আমাকে এ নিয়ে একটু ভাবতে দিন।” কয়েক দিন পর উসমান (রা) উমরকে (রা) বললেন, “আমার মনে হয় আমি এখনই বিয়ে করতে চাই না।” এখানে একটি গোপনীয় ব্যাপার ছিল যা তিনি সেই মুহূর্তে উমরকে (রা) বলতে পারেননি।
উসমানের (রা) প্রত্যাখ্যানে উমর (রা) খুব দুঃখ পেলেন। তারপর তিনি আবু বকরের (রা) কাছে গিয়ে একই কথা বললেন। যদিও আবু বকর (রা) সেই সময় বিবাহিত ছিলেন, তবু উমর (রা) একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে জামাতা হিসেবে পেতে চেয়েছিলেন, এতে যদি তার কন্যা কারও ‘দ্বিতীয় স্ত্রী’ হয় তবুও। আবু বকরও (রা) উসমানের মতোই জবাব দিলেন, “আমাকে এ নিয়ে একটু ভাবতে দাও।”

এরপর তিনি বেশ কিছুদিনের জন্য উমরের (রা) সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। আবু বকরের (রা) দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে উমর (রা) আরও বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন। তাঁর কথায়, “এটি আমার কাছে উসমানের (রা) প্রত্যাখ্যানের চেয়েও অনেক বেশি বেদনাদায়ক ছিল।” কোনো কোনো বইয়ে উল্লেখ আছে, তিনি হাফসাকে বিয়ে করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার বিষয়ে নবিজির (সা) কাছে উসমান ও আবু বকরের নামে অভিযোগ করেন। নবিজি (সা) তাঁকে বলেন, “হাফসা উসমানের চেয়ে উত্তম কাউকে বিয়ে করবে এবং উসমান হাফসার চেয়ে উত্তম কাউকে বিয়ে করবে।”
উমর ততক্ষণ পর্যন্ত এই কথার মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারেননি যতক্ষণ না নবিজি (সা) নিজেই হাফসাকে বিয়ে করার প্রস্তাব করেন। আমরা জানি, উসমান (রা) পরে নবিজির (সা) আরেক কন্যা উম্মে কুলসুমকে বিয়ে করেন। আবু বকর (রা) পরে উমরকে (রা) বলেন, “হাফসার বিষয়ে সাড়া না দেওয়ায় তুমি সম্ভবত আমার সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করেছিলে।” উমর হ্যাঁ-সূচক জবাব দিলে আবু বকর বলেন, “নবিজি (সা) আমাদের কাছে হাফসার কথা উল্লেখ করেছিলেন, সেই গোপন কথাটি আমি তোমার কাছে প্রকাশ করতে পারিনি।”
নবিজি (রা) আবু বকর ও উসমানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমার স্ত্রী হিসেবে হাফসাকে তোমরা কেমন মনে কর?” এই কথা শোনার পর দুজনেই উমরকে কী বলবেন তা বুঝে উঠতে পারেননি। আবু বকর উমরকে আরও বলেন, “যদি নবিজি (সা) হাফসার জন্য প্রস্তাব না করতেন, তাহলে আমি তোমার প্রস্তাব গ্রহণ করতাম।”
এভাবে তিনি উমরকে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিলেন যে, হাফসার কোনো অসুবিধা নেই । আয়েশা (রা) বলতেন, নবিজির (সা) সঙ্গ ও ভালোবাসা পাওয়ার ক্ষেত্রে হাফসা (রা) ছিলেন তাঁর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। আমরা দেখতে পাচ্ছি, আবু বকরের (রা) কন্যা এবং উমরের (রা) কন্যা একে অপরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ঠিক তাঁদের বাবাদের মতো (তাঁরা ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করতেন)। হাফসাও আয়েশার মতো সাহসী ও সপ্রতিভ ছিলেন, তাঁর বয়সও ছিল আয়েশার বয়সের কাছাকাছি । তিনি কথাবার্তায় ছিলেন তাঁর পিতার মতই ক্ষুরধার ও বুদ্ধিদীপ্ত জানা যায়, একবার নবিজি (সা) ও হাফসার মধ্যে কিছু বিষয় নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল।

একটি বর্ণনা অনুসারে, নবিজি (সা) তাঁকে তালাক দেওয়ার কথাও ভেবেছিলেন। অন্য একটি বর্ণনা অনুসারে, তিনি একটি তালাক পর্যন্ত বলে ফেলেছিলেন। যা-ই হোক, সেই সময় জিব্রাইল (আ) এসে বললেন, “আল্লাহ আপনাকে তাঁকে ফিরিয়ে নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন, কারণ তিনি হলেন ‘সাওয়ামা কাওয়ামা’ (যিনি সর্বদা রোজা রাখেন এবং সর্বদা নামাজ কায়েম করেন), এবং তিনি হবেন জান্নাতে আপনার স্ত্রী।” ফলে নবিজি (সা) হাফসাকে ফিরিয়ে নেন। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তাঁদের দাম্পত্যের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন। হাফসার জন্য এটি ছিল অনেক বড় সম্মানের বিষয়।
কথিত আছে, নবিজির (সা) সঙ্গে আরও একবার হাফসার মতবিরোধ হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে তিনি কাঁদতে থাকলে উমর (রা) তাকে কান্নারত অবস্থায় দেখতে পান। স্বাভাবিকভাবেই উমর তাঁকে বললেন, “সম্ভবত তুমি আবার তাঁর (নবিজির) সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছ। আল্লাহর কসম, তিনি যদি আবার তোমাকে তালাক দেন, তাহলে আমি সারাজীবন আর কখনও তোমার সাথে কথা বলব না ।” অর্থাৎ তুমি তাঁর সাথে এখনই মিটমাট করে নাও।
নবি করিমের (সা) সময়ে যে অল্পসংখ্যক নারী লিখতে ও পড়তে জানতেন, হাফসা ছিলেন তাঁদের অন্যতম। উমর (রা) মারা যাওয়ার পর আবু বকরের (রা) সময়ে লিখিত মুসাহাফটি (২) (যেটি ছিল প্রথম মুসাহাফ) হাফসার হেফাজতে আসে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তা নিজের কাছে রেখেছিলেন। উসমান (রা) যখন মুসাহাফ কপি করতে চেয়েছিলেন, তখন তাঁকে তা হাফসার কাছ থেকেই নিতে হয়েছিল। তারপর সেই মুসহাফটি অনেক কপি করে ইসলামের বিভিন্ন শহরে পাঠানো হয় । হাফসা (রা) ৪১ বা ৪৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। যদি তিনি ৪৫ বছর বয়সে মারা গিয়ে থাকেন, তাহলে তৎকালীন গভর্নর মারওয়ান ইবনুল হাকাম তাঁর জানাজা পড়িয়ে থাকবেন। তাঁকে বাকি আল-ঘারকাদে দাফন করা হয়।
আরও পড়ুনঃ
