ওহুদের যুদ্ধ থেকে শিক্ষা | ওহুদের যুদ্ধ-৫, ১) আল্লাহ তায়ালা তাঁর অসীম প্রজ্ঞা দিয়ে খারাপকে ভালো থেকে পৃথক করতে চেয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে আমরা বদরের যুদ্ধের সঙ্গে ওহুদের যুদ্ধের তুলনা করতে পারি। আল্লাহ সুরা আনফালে বদরের যুদ্ধের বিষয়ে বলেছেন:
“আল্লাহ দুর্জনকে সুজন থেকে আলাদা করবেন।” [৮:৩৭] এখানে দুর্জন কারা? মুশরিকরা। আর সুজন কারা? মুসলিমরা। সুরা আল ইমরানে আল্লাহ ওহুদের যুদ্ধ সম্পর্কে একইভাবে বলেন: “অসৎকে সৎ থেকে পৃথক না করা পর্যন্ত তোমরা যে অবস্থায় রয়েছে আল্লাহ সে অবস্থায় বিশ্বাসীদের ছেড়ে দিতে পারেন না।” [সুরা আল ইমরান, ৩:১৭৯/ ওহুদের যুদ্ধ সম্পর্কেও আল্লাহ বদরের যুদ্ধের মতোই সৎ ও অসৎ পৃথক হওয়ার কথা বলেছেন। তবে দুই ক্ষেত্রে খারাপ দুই রকম লোক।
বদরের যুদ্ধের খারাপ ছিল মুশরিকরা, আর ওহুদের যুদ্ধের খারাপ ছিল মুনাফেকরা। সুতরাং কোরান অনুসারে, ওহুদের যুদ্ধ থেকে মুসলিমদের আসল লাভ হয়েছে মুনাফেকদের আসল রূপটি চিনতে পারার মধ্য দিয়ে। মুনাফেকরা কতটা খারাপ হতে পারে তা মুসলিমদের জানা প্রয়োজন ছিল। আমরা দেখেছি, যখন সত্যিকারের যুদ্ধ করা প্রয়োজন পড়ল, তখন মুনাফেকরা মুসলিমদের বিপদের মুখে ফেলে নির্দ্বিধায় বাড়ি চলে গেল।
সুরা আল-আনফালে বদরের প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহ তোমাদের প্রতিশ্রুতি দেন যে, দুই দলের এক দল তোমাদের আয়ত্তে আসবে।” [৮:৭] অন্যদিকে ওহুদের যুদ্ধের বিষয়ে আল্লাহ সুরা আল ইমরানে বলেছেন, “আর তাদের বলা হয়েছিল, ‘এসো, তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো বা রুখে দাঁড়াও।’ তারা বলেছিল, ‘যদি আমরা যুদ্ধ হবে জানতাম তবে তো নিশ্চয়ই তোমাদের অনুসরণ করতাম।’” [৩:১৬৭] আবদুল্লাহ ইবনে উবাই উপরের আয়াতে উল্লিখিত কথাগুলোই বলেছিল।
ওহুদের যুদ্ধ থেকে শিক্ষা | ওহুদের যুদ্ধ-৫ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

২) ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্তরিকতার সাথে কাজ করলে আল্লাহ সাহায্য করেন। এর অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো বদরের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ নিয়ে আল্লাহ তায়ালা সুরা আনফালে বলেন, “স্মরণ করো, আল্লাহ তোমাকে স্বপ্নে দেখিয়েছিলেন যে তারা সংখ্যায় কম। যদি তোমাকে দেখাতেন যে তারা সংখ্যায় বেশি তবে তোমরা সাহস হারাতে ও যুদ্ধের ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন (আসল পরিমাণ না দেখিয়ে)।” [৮:৪৩] অন্যদিকে ওহুদের-যুদ্ধের মতো নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করলে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসুলের অবাধ্য হলে তিনি তাঁর দেওয়া সাহায্য ফিরিয়ে নেবেন।
তবুও আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের ক্ষমা করে দিয়েছেন, তা তিনি [৩:১৫২] আয়াতে উল্লেখ করেছেন। আবার সুরা মুহাম্মদে আল্লাহ বলেছেন:
“হে মুমিনগণ, তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য কর, তাহলে তিনিও তোমাদের সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা দৃঢ় করবেন।” [৪৭:৭]
এ ছাড়া সাহাবি ও মুনাফেকদের মধ্যে বৈপরীত্য দেখুন। সাদ ইবনে মুআ (রা) বদরের যুদ্ধের সময় বলেছিলেন, “হে আল্লাহর রসুল, আপনি যদি সাগরের দিকেও ধাবিত হন, তবু আমরা ঠিক আপনার পেছনই থাকব।” অন্যদিকে ওহুদের-যুদ্ধে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই বলেছিল, “সে (মুহাম্মদ) যখন আমাদের কথা শোনেনি, তখন আমরা কেন তার কথা শুনব?” আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের এই কথার পরেই ৩০০ জন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিঠটান দেয়।
আরেকটি বিষয় এখানে লক্ষণীয়, বদরের যুদ্ধের সময় মুসলিমরা নিরস্ত্র থাকা সত্ত্বেও উদ্যমের সঙ্গে যুদ্ধ করতে রাজি ছিলেন; অন্যদিকে ওহুদের যুদ্ধে তাঁরা সম্পূর্ণ সশস্ত্র থাকার পরেও সম্পদের মোহে পড়ে দমে গিয়েছিলেন।

৩) আল্লাহ তায়ালা কাকে দিক-নির্দেশনা দেবেন, কাকে দেবেন না, একান্ত তাঁর ইচ্ছার বিষয়। তা আশ্চর্যজনক যে, ওহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কুরাইশদের প্রধান সব নেতাই শেষ পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেছে। যেমন, আবু সুফিয়ান, ইকরিমা, খালিদ ইবনে ওয়ালিদ, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া প্রমুখ। যে লোকটির (খালিদ ইবনে ওয়ালিদ) পাল্টা আক্রমণে মুসলিম বাহিনী পর্যুদস্ত হয়, তাকেই পরবর্তী সময়ে মুসলিমরা ‘সাইফুল্লাহ’ (আল্লাহর তরবারি) খেতাবে ভূষিত করে। কিন্তু এর পাশে বদরের যুদ্ধকে তুলনা করলে, কুরাইশদের মধ্যে নোংরা মানসিকতার সব নেতা বদরের যুদ্ধে মারা পড়েছে।
৪) ভালো মুসলিম হলেই আপনার বিজয় নিশ্চিত, এমন কোনো কথা নেই। বিজয়ের জন্য সংগ্রাম করতে হবে; এর কোনো বিকল্প নেই। মুসলিম হিসেবে এই দুনিয়া ও পরের দুনিয়ায় মর্যাদা পেতে হলে ধৈর্যের পরীক্ষা ও দুঃখকষ্টের মধ্য দিয়েই যেতে হবে। এমনকি নবিজির (সা) মতো নিখুঁত মানুষও যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন, তাঁকেও বিপদের মধ্য দিয়েই যেতে হয়েছিল।
৫) নবিজিও (সা) আমাদের মতোই একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন; তাঁর মধ্যে সব মানবীয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। আজও অনেক মুসলিম তাঁর অতিমানবীয় সত্ত্বায় বিশ্বাস করেন। কেউ কেউ বলেন যে, নবিজির (সা) কোনো ছায়া ছিল না; কিন্তু এ কথা সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা। ৬) ওহুদের-যুদ্ধের দ্বিতীয় অংশে অপমানজনক পরাজয়ের মূলত দুটি কারণ সম্পর্কে আমরা ধারণা করতে পারি:

প্রথমত, আল্লাহ ও তাঁর রসুলের অবাধ্য হওয়া; এবং
দ্বিতীয়ত, দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা (অর্থাৎ এই দুনিয়াকে আখেরাতের ওপরে স্থান দেওয়া)। বদরের যুদ্ধে মুসলিমরা আল্লাহর প্রতি আন্তরিক ছিলেন, তাই আল্লাহ তাঁদের সম্মানিত করেছিলেন। কিন্তু ওহুদের যুদ্ধে তাঁরা আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে অমান্য করেছিলেন, এই দুনিয়ার সুখকে পরকালের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন; সেটাই তাদের পরাজয় ডেকে এনেছিল ।
সহিহ বুখারিতে উল্লেখ আছে, উকবা ইবনে আমির (রা) বর্ণনা করেছেন, ওহুদের যুদ্ধের আট বছর পরে নবিজি (সা) ওহুদের শহিদদের জন্য একটি আবেগময় দোয়া করেছিলেন। তিনি মিম্বারের উপরে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “আমি ঝর্ণার পাশে দাঁড়িয়ে তোমাদের (ওহুদের শহিদদের) জন্য অপেক্ষা করব। আমি আল্লাহ তায়ালার সামনে তোমাদের পক্ষে সাক্ষ্য দেব।” উল্লেখ্য, এই দোয়ার সময় নবিজি (সা) বেশ অসুস্থ ছিলেন; সেটি ছিল তাঁর জীবনের শেষ সপ্তাহ । ওহুদের-যুদ্ধ থেকে মূল শিক্ষণীয় হলো: দুনিয়ার প্রতি অত্যধিক ভালোবাসা অমঙ্গল বয়ে আনে ।
আরও পড়ুনঃ
