মক্কা ও মদিনায় বদরের যুদ্ধের প্রভাব | বদরের যুদ্ধ-৬ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

মক্কা ও মদিনায় বদরের যুদ্ধের প্রভাব | বদরের যুদ্ধ-৬, ১. বদরের যুদ্ধের পরে মদিনার অধিবাসী পৌত্তলিকরা বুঝতে পারে যে এখন তাদের পৌত্তলিকতা ছাড়তে হবে। মদিনায় তাদের সংখ্যা কমতে থাকে। ক্রমশ বেশি সংখ্যক লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। পরিচিতদের চাপে পড়েও অনেকে ধর্মান্তরিত হয় । একপর্যায়ে মদিনা থেকে পৌত্তলিকতা উঠে যায় এবং মদিনার সব আরবই ইসলামের ছায়াতলে চলে আসে।

কিন্তু মদিনায় পৌত্তলিকরা ধর্মান্তরিত হওয়ার পাশাপাশি একটি নতুন প্রবণতা দেখা দেয়। তা হলো মুনাফেকি {১}। বদরের যুদ্ধের আগে সেখানে মুনাফেকি ছিল না। এই প্রবণতা শুরু হয় বদর-পরবর্তী সময় থেকে। এর নেতৃত্বে ছিল ইয়াসরিবের উপজাতিসমূহের প্রধান নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুল। জায়েদ ইবনে হারিসার মুখে বদরের যুদ্ধে নিহত কুরাইশ নেতাদের নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মন্তব্য ছিল, “বোঝা যাচ্ছে বিষয়টির সুরাহা হয়ে গেছে (অর্থাৎ আমি আর কখনই ইয়াসরিবের নেতা হতে পারব না। ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব এখন প্রমাণিত এবং মুহাম্মদের নেতৃত্বও এখন প্রশ্নাতীত)।”

নবি করিম (সা) মদিনায় আগমনের পূর্বে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুলের আশা ছিল, সে সমগ্র ইয়াসরিবের নেতা হিসেবে থাকবে। কিন্তু ইসলামের প্রসারের ফলে সে উপায়ান্তর না দেখে বাহ্যিকভাবে এই নতুন ধর্ম গ্রহণ করে। আমরা পবিত্র কোরান থেকে জানি, সে কখনই মনেপ্রাণে মুসলিম হয়নি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সে মুনাফেকই ছিল এবং ইসলামের সঙ্গে শত্রুতা করে গেছে।

 

মক্কা ও মদিনায় বদরের যুদ্ধের প্রভাব | বদরের যুদ্ধ-৬ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

মক্কা ও মদিনায় বদরের যুদ্ধের প্রভাব | বদরের যুদ্ধ-৬ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

২. আবু আল-আস ইবনুল রাবি সম্পর্কে: বদরের যুদ্ধের এক মাস পর নবিজি (সা) দুজন সাহাবিকে মক্কার বাইরের একটি নির্দিষ্ট স্থানে পাঠিয়ে সেখানে একজন ব্যক্তির জন্য কয়েকদিন অপেক্ষা করতে বলেন। সেই ব্যক্তি ছিলেন নবিজির (সা) কন্যা জয়নব। জয়নবের মদিনায় আসার বিষয়টি বেশ চমকপ্রদ । আবু আল-আসকে এই শর্তে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল যে সে মক্কায় ফিরে গিয়ে জয়নবকে নবিজির (সা) কাছে ফেরত পাঠাবে।

[মহানবি মুহাম্মদ (সা) ইসলাম প্রচার শুরু করার পর জয়নব শুরুতেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু তার স্বামী আবু আল-আস একজন মুশরিকই রয়ে যান। তখনও পর্যন্ত একজন মুসলিমের জন্য একজন মুশরিকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ থাকা অনুমোদিত (‘জায়েজ’) ছিল। এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত কোনো  আয়াত তখনও নাজিল হয়নি। আবু আল-আস সবসময়ই স্ত্রী জয়নবের সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করতেন, তাঁকে কখনও ইসলাম ধর্মের বিধিবিধান মানার ক্ষেত্রে বাধা দেননি। তিনি আরও কয়েক বছর পরে (৬ষ্ঠ হিজরিতে) ইসলাম গ্রহণ করেন ।

আবু আল-আস মুক্তি পেয়ে মক্কায় ফিরে এলে চারিদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে জয়নব তাঁর পিতা মুহাম্মদের (সা) কাছে ফিরে যেতে পারেন। কীভাবে এই গুজব ছড়িয়েছিল তা আল্লাহই ভালো জানেন। নবিজি (সা) নিজে এ নিয়ে কোনো কথা বলেননি। কিন্তু লোকেরা জানত যে আবু আল-আস কোনো মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্তি পেয়েছে। তাই তারা জয়নবের চলে যাওয়া অনুমান করে নিয়েছিল।

একদিন আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ জয়নবকে বলে, “আমি শুনেছি যে তুমি নাকি তোমার বাবার কাছে ফিরে যাবে। তোমার তো যাওয়ার দরকার নেই। তবু যদি তুমি চলে যেতে চাও, তাহলে আমাকে আগে থেকে জানিয়ে রেখো, যেন আমি তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে দিতে পারি। একজন মেয়ের কী প্রয়োজন তা পুরুষদের চেয়ে মেয়েরাই ভালো বোঝে।” হিন্দ জয়নবকে কেন এমন প্রস্তাব দিয়েছিল? সে আসলে চাইছিল না যে জয়নব সত্যিই চলে যাক। কারণ জয়নব এখানে থাকলে তাদের কাছে মুহাম্মদের (সা) অন্তত একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় জিম্মি হিসেবে রয়ে যায় ।

 

bn.islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

জয়নব হিন্দের প্রস্তাব শুনে প্রথমে কিছুটা প্রলুব্ধ হলেও পরে তাঁর মনে হয়েছিল যে এখানে কিছু একটা গোলমাল আছে। তাই তিনি চলে যাওয়ার দিনক্ষণ সম্পর্কে হিন্দকে কিছু জানাননি। যাওয়ার প্রস্তুতি শেষ হলে আবু আল- আসের ভাই কিনানা জয়নবকে শহরের বাইরে নিয়ে যান। আবু আল-আস নিজে জয়নবকে নিয়ে যেতে চাননি, কারণ তা তাঁর জন্য বিব্রতকর ছিল। তখন পর্যন্ত সবকিছু পূর্ব-পরিকল্পনা অনুসারে এগোচ্ছিল।

পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কিনানা দিনের আলোতেই জিনিসপত্রসহ জয়নবকে তার উটের পিঠের উপরে বসিয়ে মক্কার বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এভাবে প্রকাশ্যে রওনা দেওয়া মোটেই বিচক্ষণতার পরিচায়ক ছিল না। জয়নবের চলে যাবার কথা দ্রুতই মক্কার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। কুরাইশরা কালক্ষেপণ না করে জয়নবের পথ রোধ করে, তাঁকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। কিনানা তাঁকে রক্ষা করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেও পেরে উঠছিলেন না। একপর্যায়ে হাব্বার ইবনে আল-আসওয়াদ ইবনুল মুত্তালিব নামের এক কুরাইশ উটের দিকে বর্শা ছুড়ে মারলে উটটি ভয় পেয়ে লাফিয়ে ওঠে। ফলে জয়নব উটের পিঠ থেকে প্রায় ১৫ ফুট নিচে ছিটকে পড়ে যান। তিনি সে সময় গর্ভবর্তী ছিলেন। মারাত্মক আহত অবস্থায় রক্তক্ষরণের মধ্যে সেখানেই তাঁর গর্ভপাত হয়।

এ অবস্থায় কিনানা মরিয়া হয়ে জয়নবের সামনে গিয়ে দাঁড়ান এবং কুরাইশদের উদ্দেশ্যে হুংকার দিয়ে বলেন, “আল্লাহর কসম, আমার কাছে এখন  যে-ই আসবে সে-ই আমার তলোয়ার ও তিরের স্বাদ গ্রহণ করবে! আর তোমরা তো সবাই ভালো করেই জান আমি লক্ষ্যভেদ করতে কতটা দক্ষ!” ঘটনার আকস্মিকতায় কুরাইশরা কী করবে তা বুঝে উঠতে পারছিল না।

 

মক্কা ও মদিনায় বদরের যুদ্ধের প্রভাব | বদরের যুদ্ধ-৬ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

আবু সুফিয়ান খবর পেয়ে দ্রুত ঘোড়ায় চড়ে সেখানে এসে হাজির হয়। তার হস্তক্ষেপেই পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। সে কুরাইশদের সেখান থেকে চলে যেতে বলে এবং তাদের প্রতিশ্রুতি দেয় যে জয়নব মক্কাতেই থাকবে। তারপর সে কিনানার উদ্দেশ্যে বলে, “তুমি বোকার মতো কাজ করেছ! তুমি কি আশা করেছিলে যে আমরা জয়নবকে প্রকাশ্য দিবালোকে আমাদের সামনে দিয়ে নিয়ে যেতে দেব? তুমি এখন ফিরে যাও, কিছু সময় অপেক্ষা করো, তারপর সবাই যখন এই বিষয় নিয়ে কথা বলা বন্ধ করবে, তখন চুপিসারে জয়নবকে নিয়ে তাঁর পিতার হাতে তুলে দিও।

তাঁকে (জয়নবকে) এখানে আটকে রাখার কোনো কারণ আমাদের দিক থেকে নেই।” একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে আবু সুফিয়ান বাস্তবতার নিরিখেই বিষয়টির সমাধান দিয়েছে। সে বলতে চেয়েছে, সবার সামনে আমাদের অপমানিত করো না। যখন কেউ তাঁর খোঁজ করবে না তখন চুপচাপ চলে যেও। আবু সুফিয়ানের পরামর্শ মোতাবেকই পরবর্তী ঘটনা ঘটেছিল। কিছু দিন পরে এক মধ্যরাতে কিনানা আবারও জয়নবকে মক্কার বাইরে নিয়ে গিয়ে অপেক্ষমাণ সাহাবিদের হাতে তুলে দেয়; সাহাবিরা তাঁকে মদিনায় নিয়ে যান।

আরও পড়ুনঃ

Leave a Comment