নবিদের সাক্ষাৎ থেকে শিক্ষণীয় | রাতের ভ্রমণ এবং ঊর্ধ্বলোকে আরোহণ-১, অন্য নবিদের সঙ্গে আমাদের নবিজির (সা) সাক্ষাৎ সম্পর্কে একটি বহুল প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা আছে। তা হলো, সাক্ষাতের এই ক্রম নবিদের মর্যাদার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই ধারণা অনুসারে কেউ কেউ বলেন, আদমের (আ) মর্যাদা সবচেয়ে কম। কিন্তু বিষয়টি মোটেও সেরকম নয়। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখতে পাব, সেটি ছিল মহানবিকে (সা) স্বাগত জানানোর জন্য এক বিশেষ আয়োজন, একটি অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কিছু বিখ্যাত ও সম্ভ্রান্ত নবিকে পাঠিয়েছিলেন মহানবি মুহাম্মদ (সা) ভেতরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে সালাম ও শুভেচ্ছা জানানোর জন্য। নবিজিকে (সা) এখানে মূলত রাজকীয় ‘লাল গালিচা’ সম্বৰ্ধনা জানানো হলো।
নবিদের সাক্ষাৎ থেকে শিক্ষণীয় | রাতের ভ্রমণ এবং ঊর্ধ্বলোকে আরোহণ-১ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

এই সাতটি আকাশে কোথায় কোন নবি থাকবেন তা নির্বাচনে অন্য এক তাৎপর্য আছে বলে প্রতীয়মান হয়:
১) আদম (আ) শুধুমাত্র নবিগণেরই নয়, তিনি সমগ্র মানবজাতির পিতা। তাই তিনিই যে সর্বপ্রথম নবিজিকে (সা) বরণ করে নেবেন সেটাই তো স্বাভাবিক। আদম (আ) হলেন সেই ব্যক্তি যাঁকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা জান্নাতে থাকার জন্য বেছে নিয়েছিলেন। যদিও তাঁকে জান্নাত ছেড়ে যেতে হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি আবার সেখানে ফিরে যাবেন। এর মধ্যে একটি প্রতীকী বিষয় রয়েছে: আদমকে (আ) যেমন পারলৌকিক/আধ্যাত্মিক জগতের সবচেয়ে পবিত্র স্থানটি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল, তেমনি নবিজিকেও (সা) অচিরেই এই পৃথিবীর পবিত্রতম স্থানটি (মক্কা) ছেড়ে যেতে হবে। তাঁকে মক্কা থেকে বহিষ্কার করা হবে, যেমনটি পিতা আদমকে জান্নাত থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।
২) ইসা (আ) ও ইয়াহিয়া (আ)। দ্বিতীয় অভ্যর্থনাকারী হিসেবে এই দুজন অবশ্যই উপযুক্ত, কারণ তাঁরা নবিজির (সা) সবচেয়ে কাছাকাছি। ইয়াহিয়া (আ) ও ইসার (আ) পরে সময়ের হিসেবে মুহাম্মদের (সা) আগে আর কোনো নবির আগমন ঘটেনি। নিজেদের সম্প্রদায়ের লোকেরাই তাঁদের উভয়কেই হত্যা করার চেষ্টা করেছিল, এবং তাঁরা ইয়াহিয়াকে (জন দ্য ব্যাপটিস্ট) হত্যা করতে সফল হয়েছিল। নিউ টেস্টামেন্ট অনুসারে তারা বাইতুল মাকদিসে তাঁর মাথা কেটে ফেলেছিল। ইসাকেও (আ) তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা হত্যার চেষ্টা করেছিল। এখানে প্রতীকী ব্যাপারটি হলো: আল্লাহ নবি করিমকে (সা) বলছেন, তিনিই একমাত্র ব্যক্তি নন নিজেদের লোকেরা যার ক্ষতি করার চেষ্টা করেছিল।

৩) ইউসুফ (আ)। তাঁর নিজের রক্ত-সম্পর্কের ভাইয়েরাই তাঁর ক্ষতি করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁরা অনুতপ্ত হয়ে তাঁর কাছে ফিরে আসেন। এখানে প্রতীকী ব্যাপারটি হলো: তোমার নিজের রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় যাঁরা তোমাকে বহিষ্কার করেছেন, তাঁরা আবার ফিরে আসবেন এবং শেষ পর্যন্ত তোমার ধর্মমত গ্রহণ করে নেবেন। মক্কা বিজয়ের পর যখন কুরাইশরা কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে জিজেস করেছিল, “আপনি আমাদের ব্যাপারে কী করবেন?”, তখন ইউসুফকে (আ) উদ্ধৃত করে নবিজি (সা) বলেছিলেন, “আজ তোমাদের বিরুদ্ধে (আমার) কোনো অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন।” [সুরা ইউসুফ,
৪) ইদ্রিস (আ)। আমরা ইদ্রিস (আ) সম্পর্কে শুধু জানি যে, পবিত্র কোরানে আল্লাহ তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, “আর আমি তাঁকে উন্নীত করেছিলাম উচ্চমর্যাদায়।” [সুরা মরিয়ম, ১৯:৫৭] এটুকুই আমাদের জানা দরকার। আমাদের নবিজিকেও (সা) আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “আর আমি তোমাকে উচ্চমর্যাদায় উন্নীত করেছি।” [সুরা ইনশিরাহ, ৯৪:৪)
৫) হারুন (আ)। হারুন (আ) ও মুসা (আ) উভয়ের ক্ষেত্রেও কারণ একই। প্রথমে তাদের নিজেদের সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলেও পরবর্তী সময়ে মেনে নিয়েছিল।
৬) মুসা (আ)। আমাদের নবিজির (সা) পর দ্বিতীয় বৃহত্তম উম্মত হবে মুসার (সা)। তাঁর সঙ্গেই আমাদের নবিজির (সা) অভিজ্ঞতার মিল সর্বাধিক। নবিদের মধ্যে তাঁর অভিজ্ঞতা এক কথায় অতুলনীয়। প্রকৃতপক্ষে মুসার (আ) অভিজ্ঞতার ভান্ডার আমাদের নবিজির (সা) অভিজ্ঞতার চেয়েও অনেক বেশি সমৃদ্ধ। বেশ কয়েকটি সহিহ হাদিস অনুসারে, নবিজি (সা) বলেছেন, “আসলেই মুসা (আ) আমার চেয়েও বেশি দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছিলেন। কিন্তু তিনি সব সময়ই ধৈর্যশীল ছিলেন।”

[মনে রাখবেন, নবিগণ যেখানে অবস্থান করছিলেন তা বিভিন্ন স্তরের আকাশ, জান্নাত নয়। সকল নবিই এক সময় জান্নাতের উচ্চ স্তরে থাকবেন। এই মুহূর্তে তাঁদেরকে তাঁদের স্থান থেকে আকাশে (সামাওয়াত) আনা হয়েছে নবি করিমকে (সা) স্বাগত জানানোর জন্য। তাঁরা হয়তো তাঁদের নিজ নিজ কবরে প্রার্থনারত অবস্থায় আছেন। একমাত্র ব্যতিক্রম ইসা (আ), যিনি নবিজির (সা) সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নেমে এসেছিলেন। এটিও প্রতীকী। যেহেতু ইসা (আ) শেষ সময়ে আবার পৃথিবীতে অবতীর্ণ হবেন। আদমের (আ) পর থেকে জান্নাতে আর কেউ বসবাস করেনি, বিচারের দিন পর্যন্ত আর কেউ করবেও না ।]
৭) ইব্রাহিম (আ)। এখানে নবি করিমকে (আ) নিজের পূর্বপুরুষকে দেখানো হচ্ছে যিনি অন্য সকল নবির মধ্যে সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত। [মুসাও (আ) অনেক উচ্চ মর্যাদার ছিলেন। তিনি ছিলেন ‘কলিমুল্লাহ’ (যাঁর সঙ্গে আল্লাহ তায়ালা কথা বলেছেন)। কিন্তু ইব্রাহিম (আ) আরও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন ‘খলিলুল্লাহ’ (আল্লাহ তায়ালার ঘনিষ্ঠ বন্ধু)। একটি হাদিসে আছে, নবিজি (সা) বলেছেন, “আল্লাহ আমাকে এবং ইব্রাহিমকে (আ) ‘খলিল’ হিসেবে গ্রহণ করেছেন।” কেবলমাত্র দুজন মানুষই মর্যাদার ওই স্তর পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন।
ইব্রাহিম (আ) তাঁর পিঠ বায়তুল মামুরের দিকে হেলান দিয়ে বসে থাকাও একটা বিশেষ অর্থ বহন করে। আল্লাহ পবিত্র কোরানের সুরা তুরে বলেছেন, “শপথ বায়তুল মামুরের।” [৫২:৪] একটি হাদিস অনুসারে, নবিজি (সা) বলেছেন, “এটি কাবার অনুরূপ আরেকটি ঘর।” বায়তুল মামুর সম্পর্কিত এটিই একমাত্র ঘাঁটি হাদিস আছে। এর ভিন্ন ভিন্ন ভাষা প্রচলিত থাকলেও মূলত এটি একটিই হাদিস। অন্য এক ভাষা অনুসারে, “এটি আকাশের কাবা।” এটি পৃথিবীর কাবার ওপরে অবস্থিত। যদি এটি পড়ে যায় তবে তা পৃথিবীর কাবার ওপরেই পড়বে।
আল্লাহ বায়তুল মামুর সৃষ্টি করার পর থেকে প্রতিদিন ৭০ হাজার ফেরেশতা সেখানে প্রবেশ করে তাওয়াফ ও নামাজ আদায় করছেন, তাঁরা কখনই আর বের হন না। প্রতিদিনই এমনটি ঘটে। সুবহানআল্লাহ! আমরা কখনোই ফেরেশতার সংখ্যা গণনা করতে পারব না। আল্লাহ ভালো জানেন। ইব্রাহিম (আ) সেই ব্যক্তি যিনি পৃথিবীতে কাবাঘর তৈরি করেছিলেন। সুতরাং আকাশের কাবার সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা অবশ্যই যথাযথ ।
আরও পড়ূনঃ
