সাদ ইবনে মুআদের (রা) বিখ্যাত বক্তব্য | বদরের যুদ্ধ-২, এতক্ষণে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে মুসলিমরা একটি সুসজ্জিত ও শক্তিশালী বাহিনীর মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন। তাই নবিজিও (সা) বুঝতে পারছিলেন, তাঁকে এখন মুসলিম বাহিনীকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে, তাঁদের উজ্জীবিত করতে হবে। সন্দেহ নেই, সাহাবিরা অনেকটাই ভীত হয়ে পড়েছিলেন।
সাদ ইবনে মুআদের (রা) বিখ্যাত বক্তব্য | বদরের যুদ্ধ-২ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
নবি করিম (সা) সাহাবিদের একটি সমাবেশ ডেকে সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা কী করব?” সবাই বুঝতে পারছিল, এ অবস্থায় অন্য কোনো উপায় নেই। এখান থেকে পালিয়ে যাওয়াটা হবে চরম অপমানের বিষয় । কুরাইশদের বাহিনী সামনে চলে এসেছে, তাদের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে দেখা হতে যাচ্ছে। তবে সবাইকে নিয়ে ‘শুরা’ বা পরামর্শ করা এই প্রথমবার নয়, আমরা এরকম আগেও দেখেছি। পরামর্শ করা ইসলামের দৃষ্টিতে একটি প্রশংসনীয় কাজ।
যদিও নবিজির (সা) জন্য এই পরামর্শ গ্রহণের কোনো প্রয়োজনই ছিল না, কারণ তিনি সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে ওহি পেয়ে। গিয়েছিলেন। তারপরও তিনি পরামর্শ করছেন। এ ছাড়া, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দলের সদস্যদের মতামত নেওয়া তাদের মনোবল বাড়ানোর অন্যতম সেরা পদ্ধতি। শুরুতেই আবু বকর (রা) দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা এবং নবিজির (সা) প্রতি সালাম নিবেদন করে বললেন, “হে আল্লাহর রসুল, আপনি যা ভালো মনে করেন, তা-ই করুন। আমরা আপনার পেছনে আছি।”

একথা বলার পর আবু বকর বসে পড়লে নবিজি (সা) তাঁকে প্রশংসা করে ধন্যবাদ জানালেন। তারপর আবার সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের কী মনে হয় আমাদের কী করা উচিত?” এবার সভাকক্ষে সবাই নীরব। অতঃপর উমর (রা) দাঁড়িয়ে আবু বকর যা বলেছিলেন তা-ই আরেকটু জোর দিয়ে পুনরাবৃত্তি করলেন, “হে আল্লাহর রসুল, আপনি যা ভালো মনে করেন, তা-ই করুন। নিশ্চয়ই আপনি আমাদের যা করতে বলবেন আমরা তা-ই করব।”
কথা শেষ করে উমর বসে পড়লেন। নবিজি (সা) তাঁকেও প্রশংসা করে ধন্যবাদ দিলেন । আবারও নবিজি (সা) তাঁদের একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের কী মনে হয়, আমাদের কী করা উচিত?”
আবার সবাই চুপচাপ; কেউ-ই বুঝে উঠতে পারছিলেন না তিনি কী চাচ্ছেন। এবার আল-মিকদাদ ইবনে আমর নামের এক মুহাজির উঠে দাঁড়ালেন। তিনি সম্ভবত ভেবেছিলেন যে আবু বকর (রা) ও উমর (রা) যথেষ্ট জোরের সঙ্গে কথাগুলো বলেননি। তাই তিনি তেজোদীপ্ত কণ্ঠে বললেন, “হে আল্লাহর রসুল, আল্লাহ আপনাকে যেভাবে আদেশ করেছেন সেভাবেই করুন। আমরা আপনার পেছনে আছি। হে আল্লাহর রসুল, বনি ইসরাইল মুসাকে (আ) যেমনটি বলেছিল। (‘তুমি এবং তোমার ঈশ্বর গিয়ে যুদ্ধ করো। আমরা এখান থেকে সরছি না।’), আমরা সেরকম আপনাকে বলব না। বরং আমরা বলব, আপনি এবং আপনার ঈশ্বর যুদ্ধ করুন। এবং আমরা আপনার ঠিক পেছনেই আছি। হে আল্লাহর রসুল! আপনি যদি আমাদেরকে পৃথিবীর শেষ প্রান্তেও নিয়ে যান, তবু আমরা আপনাকে অনুসরণ করব, যতক্ষণ না আমাদের ওপর আল্লাহর অন্য কোনো নির্দেশ আসে।”

সুবহানআল্লাহ! এর চেয়ে বেশি স্পষ্ট করে আর কী-ই বা বলা যেতে পারে! নবিজি (সা) আল-মিকদাদকেও প্রশংসা করে ধন্যবাদ দিলেন। কিন্তু তিনি চতুর্থবারের মতো একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের কী মনে হয়, আমাদের কী করা উচিত?” এবার সবাই বিমূঢ়। নবিজি (সা) তাদের কাছে সত্যিই কী শুনতে চাচ্ছেন? আসলে তিনি আনসারদের কাছ থেকে শুনতে চেয়েছিলেন। এখন পর্যন্ত যাঁরা কথা বলেছেন—আবু বকর (রা), উমর (রা) এবং আল-মিকদাদ (রা)-এঁরা সবাই ছিলেন মুহাজির।
আকাবার দ্বিতীয় চুক্তির কথা স্মরণ করুন, আনসারগণ নবি করিমকে (সা) প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তাঁরা নিজের পরিবারের মতো করে তাঁকে সুরক্ষা দেবেন। তবে বদর তো সুরক্ষার বিষয় নয়। সেখানে তো আক্রমণ- প্রতিআক্রমণের ঘটনা ঘটবে। আনসাররা তো আক্রমণাত্মক কিছু করার জন্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। খুব বিনীতভাবে এই প্রথমবারের মতো আনসারদের জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, তাঁরা আক্রমণাত্মক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন কি না।
লক্ষ করুন, নবিজি (সা) তাঁদেরকে সরাসরি কিছু বলে বেকায়দায় ফেলতে চাচ্ছেন না। চতুর্থবারের মতো তিনি একই প্রশ্ন করলে আনসারদের জ্যেষ্ঠ নেতা সাদ ইবনে মুআদ উঠে দাঁড়িয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করলেন, “সম্ভবত আপনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন, হে আল্লাহর রসুল?” জবাবে নবিজি (সা) বললেন, “হ্যাঁ।” তখন সাদ সেই বিখ্যাত বক্তব্যটি দেন: “হে আল্লাহর রসুল! সর্বোপরি আমরা আপনার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছি, আপনার ওপর আস্থা রেখেছি, এবং সাক্ষ্য দিয়েছি যে আপনি যা নিয়ে এসেছেন তা পুরোপুরি সত্য। আমরা আপনাকে আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি এবং শপথ নিয়ে বলেছি যে, আমরা আপনার কথা শুনব এবং আপনার আনুগত্য করব।”

কত চমৎকারই না ছিল সাদের উত্তর। তিনি তো চুক্তির শপথের শুধু ওই ন্যূনতম অংশটুকুই উল্লেখ করে বলতে পারতেন, ‘প্রতিশ্রুতি ছিল কেবল আপনাকে রক্ষা করার।’ বরং তিনি শপথের অন্য অংশও উল্লেখ করেছেন, যেখানে লেখা ছিল, ‘আমরা আপনাকে মেনে চলব।’ তিনি আইনের আক্ষরিক অর্থে না গিয়ে এর মর্মবাণী গ্রহণ করেছেন।
এরপর তিনি বললেন: “হে আল্লাহর রসুল, আপনি যা উপযুক্ত মনে করেন, তা-ই করুন। আমরা আপনার সঙ্গে আছি। যিনি আপনাকে সত্য বার্তা দিয়ে প্রেরণ করেছেন, তাঁরই শপথ করে বলছি, আপনি যদি আমাদের দৌড়ে গিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেন, আমরা তবু আপনার পেছনেই থাকব। আমরা আগামীকাল শত্রুর মোকাবেলা করতে মোটেই ভয় পাচ্ছি না। আমরা অবশ্যই আপনাকে যুদ্ধের সময় আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা দেব। এবং ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ আপনাকে আমাদের মাধ্যমে তা-ই দেবেন যা আপনাকে সন্তুষ্ট করবে। অতএব আল্লাহর নেয়ামতের পথে এগিয়ে যান। আমরা আপনার ঠিক পেছনেই আছি।”
সাদ ইবনে মুআদের এই কথাগুলো শুনে নবি করিম (সা) এতটাই খুশি হলেন যে তাঁর মুখখানা চাঁদের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তিনি নতুন করে উজ্জীবিত হয়ে উঠলেন। তিনি আবার তাঁদের বললেন, “আল্লাহর কসম, আল্লাহ আমাকে দুটির মধ্যে একটির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর এটিই সেটি (অর্থাৎ উমাইয়া কুরাইশ বাহিনীর মোকাবেলা)। এবং তাদের প্রত্যেকে (আবু জেহেল, ইবনে খালাফ প্রমুখ) আগামীকাল মারা যাবে।” এরপর তিনি যুদ্ধের আসল প্রস্তুতির কাজ শুরু করলেন।
আরও পড়ুনঃ
