যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল | খন্দকের (আহজাবের) যুদ্ধ-৩ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল | খন্দকের (আহজাবের) যুদ্ধ-৩, অবরোধের ২০তম দিনে হঠাৎ করেই এক লোক মুসলিম শিবিরে ঢুকে পড়েন। তাঁর নাম ছিল নুয়ায়েম ইবনে মাসউদ। তিনি ছিলেন গাতাফান গোত্রের। তিনি সোজা নবিজির (সা) কাছে গিয়ে বলেন, “আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। তাই আপনি কী চান তা আমাকে বলুন।”

যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল | খন্দকের (আহজাবের) যুদ্ধ-৩ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল | খন্দকের (আহজাবের) যুদ্ধ-৩ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

তিনি যেহেতু মক্কা বা মদিনার কেউ ছিলেন না, তাই আমরা তাঁর সম্পর্কে বেশি কিছু জানি না। আমরা শুধু জানি, তাঁর মাধ্যমে কীভাবে যুদ্ধের মোড় ঘুরে গিয়েছিল। তবু নুয়ায়েম সম্পর্কে আগের ছোটখাটো যে দুএকটা ঘটনা আমরা জানতে পারি সেগুলো নিয়ে এখানে আলোচনা করব। মক্কা বিজয়ের সময়ে তিনি গাতাফান গোত্রের পক্ষ থেকে পতাকা বহন করেন, যা ছিল একটি সম্মানের বিষয়।

বড় নুয়ায়েম ছিলেন গাতাফান গোত্রের অভিজাতদের একজন, তবে নেতা হিসেবে ছিলেন দ্বিতীয় স্তরের। আবু সুফিয়ানের সঙ্গে তাঁর ভালো বন্ধুত্ব ছিল। চতুর্থ হিজরির দিকে একদিন তিনি ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে মক্কায় যান। সেখানে আবু সুফিয়ান তাঁকে বলে, “তোমার একটা সাহায্য আমার দরকার। আমরা মুহাম্মদকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে আমরা বদরে আবারও তার মুখোমুখি হব। কিন্তু এবছর ফসল ভালো হয়নি, ব্যবসার অবস্থাও ভালো নয়। তাই এবার আমরা যেতে পারছি না। তুমি মুহাম্মদের (সা) কাছে গিয়ে তাকে যুদ্ধে না আসার জন্য রাজি করাবে, যেন লোকেরা ভাবে যে সে-ই যুদ্ধ করতে আসেনি, আমরা নয়।”

আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে অর্থকড়ি পাওয়ার লোভে নুয়ায়েম এই কাজটি করতে রাজি হন। তিনি এই উদ্দেশ্যে মদিনায় গিয়ে নবিজির (সা) সঙ্গে দেখা করে বানিয়ে বানিয়ে বলেন যে, তিনি কুরাইশের বিশাল বাহিনীকে বদরের দিকে যাত্রা করতে দেখেছেন। তিনি আসলে নবিজিকে (রা) ভয় দেখাতে চেয়েছিলেন, যাতে মুসলিমরা বদরের দিকে পা না বাড়ায়। কিন্তু নবিজি (সা) তৎক্ষণাৎ বলেন, “আল্লাহর কসম, আমি একা থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করব।”

নুয়ায়েম এভাবেই প্রথমবারের মতো নবিজির (সা) সংস্পর্শে আসেন। এর পরে তাঁর সম্পর্কে সম্ভবত হিজরতের চতুর্থ বছরের শেষের দিকে বা পঞ্চম বছরের প্রথম দিকের আরেকটি ছোট ঘটনার কথা জানা যায়। সেই সময় নবিজি (সা) নুয়ায়েমের উপগোত্রের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিলেন। চুক্তিটি ছিল কুরাইশদের কাফেলার ব্যাপারে কী করা হবে তা নিয়ে। নবিজি (সা) সেই চুক্তির বিষয়ে নুয়ায়েমের সঙ্গেই মূল আলোচনা করেছিলেন।

ধারণা করা যায়, এইসব ধারাবাহিক ঘটনা নুয়ায়েমের মনের ওপর বেশ প্রভাব ফেলেছিল। তিনি নবিজির (সা) সাহসিকতা ও সত্যবাদিতার প্রমাণ পান এবং মদিনায় মুসলিমদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম ইসলামের সুন্দর দিকগুলো লক্ষ করে মুগ্ধ হন। একপর্যায়ে তিনি ইসলাম গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। পরের বার (খন্দকের যুদ্ধে) যখন তিনি নবিজির (সা) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, ততদিনে তিনি একজন ‘গুপ্ত’ মুসলিম হয়ে গেছেন। সেই সময়ে তাঁর পুরো গোত্রের একমাত্র তিনিই মুসলিম ছিলেন। আল্লাহ এভাবেই কোনো কোনো মানুষকে সাহায্য করেন, যেমনটি তিনি পবিত্র কোরানে বলেছেন:

“যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, তিনি (আল্লাহ) তার জন্য (সংকট থেকে উত্তরণের) পথ করে দেন। আর তাকে তার ধারণাতীত উৎস থেকে জীবনের উপকরণ দান করেন।” [সুরা তালাক, ৬৫:2-3]

এভাবে আল্লাহর ইচ্ছাতেই গাতাফান গোত্রের নুয়ায়েম ইবনে মাসউদ হঠাৎ মধ্যরাতে মুসলিম শিবিরে এসে হাজির। অন্য কথায়, আল্লাহ কোনো আভাস-ইঙ্গিত নুয়ায়েমের মাধ্যমে মুসলিমদের কাছে সাহায্য পাঠালেন। নুয়ায়েম এসে নবিজিকে (সা) বললেন, “হে আল্লাহর রসুল, আমি আপনার সেবায় নিয়োজিত আছি। আপনি আমাকে যা করতে বলবেন, আমি তা-ই করব।” নবিজি (সা) তাঁকে বললেন, “তুমি তো কেবল একজন ব্যক্তি মাত্র। ফিরে যাও এবং আমাদের রক্ষা করার জন্য যা কিছু তোমার পক্ষে সম্ভব তা করো।”

নুয়ায়েম বললেন, “হে আল্লাহর রসুল, আপনি কি আমাকে অনুমতি দেবেন, যেন আমি যা-কিছু বলতে পারি?” অর্থাৎ আপনি কি আমাকে এমন কোনো কৌশল প্রয়োগের অনুমতি দিচ্ছেন যেটাকে সৎ কৌশল বলা যাবে না?’ নবিজি (সা) বললেন, “যুদ্ধ মানেই কৌশল আর ছল-চাতুরি।” লক্ষ করুন, আরবিতে এই সংক্রান্ত শব্দটি হলো ‘খিদা’, ‘খিয়ানা’ নয় ।

 

bn.islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

খিদা শব্দের অর্থ কৌশল, ছল-চাতুরি, ফন্দি ইত্যাদি। আর খিয়ানা অর্থ বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা ইত্যাদি। ইসলাম প্রকৃত যুদ্ধের সময় ‘ফিদা’ ব্যবহারের অনুমতি দেয়। প্রকৃতপক্ষে, প্রতিটি জাতিই যুদ্ধের সময় এমনটা করে। বিখ্যাত সমরকৌশলবিদ, দার্শনিক ও লেখক সান জু তাঁর ‘দ্য আর্ট অফ ওয়ার’ বইয়ে লিখেছেন, “সব যুদ্ধই ছল-চাতুরির ওপর ভিত্তি করে হয়।” আসলে বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ এভাবেই হয় । খিদার মাধ্যমে আপনি চাতুরির আশ্রয় নিচ্ছেন। আপনি কোনো প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন না, আপনি কেবল কিছু কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে কাউকে ধোঁকায় ফেলছেন।

অন্যদিকে, ইসলাম কখনও খিয়ানার অনুমতি দেয়নি। খিয়ানা মানে আপনি কোনো প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন কিন্তু আপনি জানেন যে তা আপনি ভাঙবেন। খিয়ানা মানে কারও সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে তা ভঙ্গ করা। খিয়ানা মানে কাউকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তার পিঠে ছুরি মারা। এ রকম করা ইসলামে হারাম।

নুয়ায়েম নবিজির (সা) এই উক্তিটিকে তাঁর সম্মতি বলে ধরে নিয়ে তিনটি কাজ করলেন:

১. আৰু সুফিয়ান ছাড়াও বনু কুরায়জার লোকদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সখ্যতা ছিল। তিনি প্রথমে এক মধ্যরাতে বনু কুরায়জার নেতাদের কাছে গিয়ে বললেন, “তোমরা কি আমাকে চিনতে পারছ? আমরা এর আগে একসঙ্গে কাজ করেছি। এখন আমি এখানে এসেছি তোমাদের উপকার করার জন্য। এই জমি তো তোমাদের জমি, এই টাকাপয়সা তো তোমাদের টাকাপয়সা, এই সম্পত্তি তো তোমাদের সম্পত্তি (অর্থাৎ, কোনো ঝামেলা হলে তো তোমাদেরই ক্ষতি হবে  বেশি, তোমাদেরই সবকিছু হারাতে হবে)।

কিন্তু কুরাইশরা যদি এখান থেকে ফিরে চলে যায়, তাহলে তারা কোনো কিছুই হারাবে না। তারা যদি আক্রমণ করতে পারে তাহলে তো ঠিক আছে। কিন্তু যদি না পারে, তাহলে তো তারা চুপিসারে এখান থেকে চলে যাবে। আর দিনশেষে তোমরাই এর পরিণতি ভোগ করবে। তাই আমি তোমাদের পরামর্শ দেব, তোমরা যুদ্ধ করো না, যতক্ষণ না কুরাইশরা তাদের সম্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে ৭০ জনকে জিম্মি হিসেবে তোমাদের কাছে দেয়। তাহলে মুহাম্মদের বিরুদ্ধে লড়াই শেষ না করা পর্যন্ত (অর্থাৎ, নিজেদের লোকদের ফেলে) চলে যেতে পারবে না।” বনু কুরায়জার কাছে নুয়ায়েমের এই কথাগুলো বিবেচনাপ্রসূত বলে মনে হলো। এভাবেই আল্লাহ নুয়ায়েমের মাধ্যমে নতুন এই পরিকল্পনা করলেন। এটি আসলে এক প্রকার ‘ইলহাম’, আল্লাহর কাছ থেকে নবি ছাড়াও অন্যদের পাওয়া অন্তঃপ্রেরণার একটি দৃষ্টান্ত ।

 

যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল | খন্দকের (আহজাবের) যুদ্ধ-৩ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

২. পরের দিন সকালে নুয়ায়েম কুরাইশদের শিবিরে গিয়ে আবু সুফিয়ানকে বললেন, “আপনি তো ভালো করেই জানেন, আমি কে, আমার গোত্রের লোকদের মধ্যে আমার অবস্থান কেমন। আমার কাছে একটি খবর এসে পৌঁছেছে, যা আমি মনে করছি যে আমাদের বন্ধুত্বের কারণেই আপনাকে বলা উচিত। তবে দয়া করে এই বিষয়টি আপনার আর আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবেন।

জেনে রাখুন, বনু কুরায়জা পিছু হটছে। তারা মুহাম্মদের কাছে খবর পাঠিয়েছে, ‘আমরা যদি কুরাইশদের ৭০ জন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য আপনার হাতে তুলে দিতে পারি, তাহলে কি আপনি আমাদের অবিবেচনাপ্রসূত কাজকে (অর্থাৎ আমরা যা করেছি তা) ক্ষমা করে দেবেন?” তারপর তিনি আবু সুফিয়ানকে বললেন, “যদি বনু কুরায়জার লোকেরা আপনার কাছে এসে আপনাদের ৭০ জন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে নিয়ে যেতে চায়, তাহলে বুঝবেন যে এটাই তাদের চালাকি এবং বিশ্বাসঘাতকতার লক্ষণ।”

৩. সবশেষে নুয়ায়েম নিজের গোত্র গাভাফানের কাছে গিয়ে বললেন, “কুরাইশরা যে কোনো সময় ফিরে চলে যেতে পারে, আর বনু কুরায়জাও যে কোনো সময় ভোল পাল্টে ফেলতে পারে। বনু কুরায়জা তাদের কৃতকর্মের ক্ষতিপূরণ হিসেবে গাতাফানের ৭০ জন এবং কুরাইশের ৭০ জনকে মুহাম্মদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ভাবছে। তাই তারা যদি আমাদের কাছে এসে ৭০ জন লোক চায়, তবে তাদের তা দেওয়া মোটেই ঠিক হবে না।”

নুয়ায়েমের পরিকল্পনা ও পরামর্শ মোতাবেক কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বনু কুরায়জার একজন দূত কুরাইশদের কাছে গিয়ে হাজির হলো। তার নাম ছিল আড্ডাল ইবনে সামুয়েল। সে আবু সুফিয়ানকে বলল, “তোমরা কুরাইশরা অনেক দেরি করে ফেলেছ (উল্লেখ্য, ততদিনে কমপক্ষে তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে); তোমরা শুধু মুখের কথা ছাড়া কাজের কাজ কিছুই করনি। যা-ই হোক, চলো,

এখন আমরা দিন-তারিখ ঠিক করি, কখন আমরা যার যার পক্ষ থেকে আক্রমণ করব। তোমরা তোমাদের পক্ষ থেকে, আমরা আমাদের পক্ষ থেকে এবং গাতাফান তাদের পক্ষ থেকে। আমরা মুহাম্মদের ব্যাপারে একটা রফা করে ফেলব। তবে দিন-তারিখ ঠিক করার আগে তোমাদের মধ্য থেকে ৭০ জন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে আমাদের কাছে দাও, কারণ আমরা নিশ্চিত হতে চাই, যুদ্ধ মারাত্মক আকার ধারণ করলে তোমরা যেন পিছুটান না দাও ।”

আবু সুফিয়ান তখন বলল, “আমাকে এ নিয়ে ভাবতে দাও।” ফলে বনু কুরায়জার দূত সেদিন খালি হাতে ফিরে গেল। সন্দেহের বীজ এখানেই বপন করা হয়ে গেল । আহজাব বাহিনীর পরাজয়ের সূচনাও এখান থেকেই শুরু হলো।

আরও পড়ুনঃ

Leave a Comment