আতিকা বিনতে আবদুল মুত্তালিবের দেখা স্বপ্ন | বদরের যুদ্ধের প্রস্তুতি, আতিকা বিনতে আবদুল মুত্তালিব ছিলেন আবদুল্লাহ ও আবু তালিবের আপন বোন; সে হিসেবে নবিজির (সা) আপন ফুফু।
[আনুসঙ্গিক বিষয়: আতিকা কি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন? ইবনে ইসহাক উল্লেখ করেছেন, নবিজির (সা) ফুফুদের মধ্যে একমাত্র সাফিয়াই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তবে ইবনে সাদের বর্ণনা অনুসারে, আতিকাও ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন; তিনি পরবর্তীকালে মদিনায় হিজরত করেন ও সেখানেই ইন্তেকাল করেন। তবে সত্যি বলতে কী, আতিকার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে; কারণ এ স্বপ্নের পরে আতিকার কাছ থেকে আমাদের কোনো বিষয়েই কোনো বর্ণনা নেই। তিনি যদি ধর্মান্তরিত হতেন তাহলে সেই কাহিনি আমরা জানতে পারতাম। তা ছাড়া সিরাহের ক্ষেত্রে ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অধিকতর গ্রহণযোগ্য । আল্লাহ ভালো জানেন ।]

আতিকা বিনতে আবদুল মুত্তালিবের দেখা স্বপ্ন | বদরের যুদ্ধের প্রস্তুতি | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
দামদামের মক্কায় পৌঁছার তিন দিন আগে আতিকা একটি স্বপ্ন দেখলেন। সেটি ছিল ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ। তিনি জেগে উঠে উত্তেজিত অবস্থায় তাঁর ভাই আব্বাসকে ডেকে তুললেন। কাছাকাছি বয়স হওয়ায় আব্বাসের সঙ্গে তাঁর বন্ধন ছিল বেশ দৃঢ়। তিনি আব্বাসকে বললেন: “আমি একটি স্বপ্ন দেখেছি যা নিয়ে আমার খুবই চিন্তা হচ্ছে।”
আব্বাস: কী হয়েছে? আমাকে বলো।
আতিকা: স্বপ্নে দেখলাম, তিন দিনের মধ্যে এক ব্যক্তি উটের পিঠে চড়ে মক্কায় আসবে। সে প্রথমেই কাবায় গিয়ে চিৎকার করে তিনবার বলবে, ‘হে বিশ্বাসঘাতকেরা, তিন দিনের মধ্যে তোমরা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করো।’ তারপর সে কাবার ছাদের উপরে উঠে একই কথা বলবে, তারপর ‘আবু কুবায়েস’ পাহাড়ের উপর (আশেপাশের অঞ্চলের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ) উঠেও একই কথা বলবে। তারপরে সে একটি বড় পাথর নিয়ে আবু কুবায়েস পাহাড়ের উপর থেকে নিয়ে ফেলে দেবে, সেটি পড়ার সময় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে মক্কার প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে আঘাত করবে।”
প্রশ্ন হলো, এখানে কুরাইশদের কেন বিশ্বাসঘাতক বলা হচ্ছে? একটি মত অনুসারে কারণটি হলো, আরব ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো তারা তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির (বংশ বা রক্তের সম্পর্কের) সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে; তারা নিজেদের উপজাতির মানুষদের তাদের সঙ্গে থাকতে দেয়নি। আরেকটি মত অনুসারে, তাদেরকে বিশ্বাসঘাতক বলার কারণ, তারা তাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিমের (আ) ধর্মের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। পাথরটি ভেঙে প্রতিটি বাড়িতে আঘাত করার বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়: মক্কার প্রতিটি বাড়িই দুর্যোগে পতিত হবে। এখানে দুর্যোগের ব্যাখ্যাটি হলো, সব পরিবারের একাধিক মানুষের মৃত্যু।
আব্বা’স খুব চিন্তিত হয়ে আতিকাকে বললেন, “এই স্বপ্নটি খুবই মারাত্মক। আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে, তুমি যদি সবার কাছে এই স্বপ্নের কথা প্রকাশ করে দাও তাহলে সমস্যায় পড়ে যাবে। তুমি বরং এটি নিজের মধ্যেই রাখো। এই স্বপ্নের কথা কাউকে বলো না।” কথিত আছে, আতিকা প্রায়ই এমন সব স্বপ্ন দেখতেন, যেগুলো সত্যি হতো। আল্লাহ তায়ালা কখনো কখনো কিছু মানুষকে সত্য স্বপ্ন দেখান; যেমন ইউসুফের (আ) সময়ে সেখানকার রাজা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন [সুরা ইউসুফ, ১২:৪6] (৩)। রাজা কিন্তু মুসলিম ছিলেন না। এই জাতীয় স্বপ্ন অমুসলিমরাও দেখতে পারে।]
আব্বাস আতিকাকে নিষেধ করেছিলেন কাউকে না বলতে, কিন্তু তিনি নিজেই তা মানেননি। তিনি তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওয়ালিদ ইবনে উতবাকে স্বপ্নের কথাটি জানিয়ে বলেন, “হে ওয়ালিদ, দয়া করে অন্য কাউকে বলবে না।” ওয়ালিদ কাউকে না বলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সে তার পিতা উতবাকে তা বলে, “আব্বাস কাউকে না বলার জন্য আমার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছে… এভাবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মক্কার সব লোক স্বপ্নটি সম্পর্কে জেনে যায়। আব্বা’স তখনও ভাবছিলেন যে কেউ জানে না, কারণ তিনি তো কেবল ওয়ালিদকে বলেছিলেন।
আমরা স্বপ্নটি যেভাবেই ব্যাখ্যা করি না কেন, এখানে স্পষ্টতই সর্বনাশ ও ভয়ের লক্ষণ রয়েছে। ‘তিন দিনের মধ্যেই তোমরা মারা যাচ্ছ, এবং পাথরের খণ্ড এসে তোমাদের বাড়িতে বাড়িতে আঘাত করবে’— এমন কথা কখনই সুখকর হতে পারে না। এই স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার জন্য কোনো স্বপ্ন-বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। সহজেই বোঝা যায়, এটি কুরাইশদের বিরুদ্ধে। তাই তারা বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি।

যা-ই হোক, আব্বা’স বাড়িতে ঘুমাতে গেলেন। তিনি জেগে ওঠার আগেই শহরের প্রত্যেকটি লোক স্বপ্নের কথাটি জেনে গেছে এবং এ নিয়ে কানাঘুষা করছে। তবে সবার এই জেনে যাওয়ার ব্যাপারটি আব্বা’স এখনও জানেন না। সেই সময়ের আরবদের/কুরাইশদের রীতি ছিল আসরের পরে কাবায় তাওয়াফ করা। আব্বাস সেদিনের প্রাত্যহিক ব্যবসার কাজকর্ম সেরে তাওয়াফ করার জন্য কাবায় গিয়ে হাজির হলেন। সেখানে তিনি আবু জেহেলকে তার লোকজন- পরিবেষ্টিত অবস্থায় দেখতে পেলেন। আবু জেহেল তাঁকে বলল, “হে আব্বা’স, তোমার কাজ (তাওয়াফ) শেষ হলে এখানে আসো।” আব্বাস তখনও ঠাহর করে উঠতে পারেননি সেখানে কী হচ্ছে; তিনি ধারণা করতে পারেননি যে আবু জেহেল স্বপ্নের ব্যাপারটি ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছে।
আব্বাস তাওয়াফ শেষ করে আবু জেহেলের কাছে গেলেন। আবু জেহেল তাঁকে বলল: “হে আবদুল মুত্তালিবের সন্তানেরা (অর্থাৎ বনু হাশিম), তোমরা কবে থেকে একজন মহিলা নবিকেও পেলে?” [আবু জেহেলের কণ্ঠে ছিল পরিষ্কার বিদ্রূপ আব্বা’স। আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?
আবু জেহেল: বুঝলাম যে তোমরা তোমাদের মধ্যে একজন পুরুষ নবি খুঁজে পেয়েছ। তাতে কি তোমরা সন্তুষ্ট নও যে এখন তোমাদের একজন মহিলা নবিও খুঁজে পেতে হবে যে ভবিষ্যদ্বাণী করবে? তিন দিন পার হয়ে গেলেও যদি কিছু না হয়, তাহলে আমরা তোমাদের আরবের সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী হিসেবে কাগজে লিখে তা কাবার গায়ে ঝুলিয়ে রাখব। অনেক হয়েছে। এটা সত্যি না হলে এবার আমরা তোমাদের জনসমক্ষে অপদস্থ করব।
আবু জেহেল বেশ রেগে গিয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় এবং অভিযোগের তীব্রতায় আব্বাস এতটাই অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন যে, তিনি স্বপ্নের পুরো ঘটনাই বেমালুম অস্বীকার করলেন। আব্বা’স পরবর্তী সময়ে নিজেই তা বর্ণনা করেছেন।
কিন্তু আবু জেহেল যে আব্বাসকে অপদস্থ করল এই খবরটিও সবার মধ্যে জানাজানি হয়ে গেল। আমরা জানি, বনু মাখজুম ও বনু হাশিম গোত্রের মধ্যে রেষারেষি ছিল। আব্বাসকে অপমান করার মধ্য দিয়ে আবু জেহেল আসলে বনু হাশিমকেই লোকসমক্ষে অপমান করল। এই অপমানের যন্ত্রণায় এখন বনু হাশিম ফুঁসছে।

আব্বাস বাড়িতে ফিরে আসার আগেই তাঁর গোত্রের নারীরা সবকিছু জেনে গিয়েছিলেন। আব্বাস ফিরে আসার পর নারীরা তাঁকে কটাক্ষ ও বিদ্রুপ করে বলতে লাগলেন, “তুমি কি পুরুষ নও? তোমার পুরুষত্ব কোথায় গেল? তুমি কি নিজের পরিবারের নারীদের রক্ষা করতে পারো না? তোমার কি লজ্জা নেই?
তোমার বোনকে অপমান করা হলো, পুরো বনু আবদুল মুত্তালিবকে অপমান করা হলো, আর তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখলে?”
সেই মুহূর্তে আব্বাস সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি পরদিন আবু জেহেলকে প্রকাশ্যে মোকাবেলা করে তার বক্তব্য খণ্ডন করবেন। বিষয়টি এখন আর আতিকার স্বপ্নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; কুরাইশদের দুই গোত্রের মান-মর্যাদার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আব্বা’স পরবর্তী সময়ে বর্ণনা করেছেন, “সারাদিন ধরে বনু আবদুল মুত্তালিবের সব নারী এসে আমাকে একই কথা শুনিয়ে গিয়েছিল। তাই ভাবছিলাম, আগামীকাল আমি কী বলতে পারি।”
পরদিন ঘুম থেকে উঠেই আব্বাস আৰু জেহেলকে খুঁজতে কাবার কাছে গেলেন। তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন, “আমি কাবায় এসে আবু জেহেলকে দূর থেকে দেখতে পেলাম। আমাকে দেখামাত্রই তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে আমার দিক থেকে ঘুরে উল্টো দিকে হেঁটে চলে যাচ্ছিল। আমি ভাবলাম, তার কী হয়েছে? তার কি এখন আমার মুখোমুখি হওয়ার সাহস নেই? এবার আমি নিজেই এগিয়ে তার কাছে গিয়ে মুখোমুখি হওয়ার পর তার ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়ার কারণটি বুঝতে পারলাম।”
দ্বিতীয় দিন আবু জেহেল তাঁকে অপদস্থ করেছে। আজ তৃতীয় দিন। সেই ঘোষণাকারী ইতিমধ্যে চলে এসেছে। আব্বাস খবরটি তখনও জানতেন না, কিন্তু আবু জেহেল জানতে পেরেছিল। আবু জেহেল ভাই এতটাই বিব্রত বোধ করছিল যে আব্বাসের মুখোমুখি হতে পারছিল না।
ঘোষণাকারী আর কেউ নয়, দামদাম, যাকে আৰু সুফিয়ান পাঠিয়েছিল। দামদাম কাফেলার অবস্থা সম্পর্কে আবেগপূর্ণ বর্ণনার জন্য নিজের উটটির অঙ্গচ্ছেদ করেছিল। এক বর্ণনায় আছে, সে নাকি উটটির নাক কেটে ফেলেছিল, উটের শরীরের উপরে রক্ত ছিটিয়ে রেখেছিল, নিজের জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলেছিল যাতে তাকে বিধ্বস্ত দেখায়, এবং পেছন ফিরে মক্কায় প্রবেশ করেছিল । সবই সে করেছিল মক্কার কুরাইশদেরকে এই ধারণা দেওয়ার জন্য যে সে নিজেও আক্রমণের শিকার হয়েছে।
দামদাম চিৎকার করে বলল, “হে কুরাইশগণ, তোমাদের কাফেলা! হে কুরাইশগণ, তোমাদের কাফেলা! (অর্থাৎ কাফেলার উটগুলো সর্বনাশের মুখে পড়েছে।) আবু সুফিয়ানের কাছে গচ্ছিত তোমাদের সব ধনসম্পত্তি ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য মুহাম্মদ ও তার সঙ্গীসাথীরা আক্রমণ করেছে। তোমরা যদি এক্ষুনি জরুরিভাবে কিছু না কর, তাহলে সম্পদগুলো আর রক্ষা করতে পারবে না।”
এসব কথার পুরোটাই ছিল মিথ্যা, বানোয়াট। কারণ তখন পর্যন্ত কোনো আক্রমণের ঘটনা ঘটেনি। দামদামের ঘোষণাটি ছিল, এসো এবং যুদ্ধ করো, আবার আতিকার স্বপ্নটি ছিল ‘এসো এবং মৃত্যুকে বরণ করো’।
আরও পড়ুনঃ
