মদিনার বরকত | মদিনায় হিজরত থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

মদিনার বরকত | মদিনায় হিজরত থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা,  (১) সহিহ বুখারিতে বর্ণিত আছে, নবিজি (সা) আল্লাহ তায়ালার কাছে মদিনার জন্য দোয়া করেছেন: “হে আল্লাহ! মক্কার প্রতি আমাদের মনে যে ভালোবাসা রয়েছে, মদিনার প্রতিও আমাদের মনে তেমনই অথবা আরও বেশি ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিন।” ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন, নবিজি (সা) কোনো অভিযান থেকে ফেরার সময় যখন দূর দিগন্তে মদিনাকে দেখতে পেতেন, তখন আবেগে আপ্লুত হতেন এবং তাঁর উট বা ঘোড়াকে দ্রুত এগুতে বলতেন।

 (২) মদিনার উপকণ্ঠে অবস্থিত ওহুদ পর্বত সম্পর্কে নবিজি (সা) বলেছেন, “এটি এমন একটি পর্বত যাকে আমরা ভালোবাসি, পর্বতও (ওহুদ) আমাদের ভালোবাসে।” সুতরাং আমরা বিশ্বাস করি, ওহুদ একটি বরকতময় পর্বত যার মুসলিমদের প্রতি ভালোবাসা আছে। নবিজি (সা) আরও বলেছেন, “ওহুদ জান্নাতের একটি পর্বত।”

(৩) একটি হাদিসে আছে, দাজ্জাল মদিনায় প্রবেশ করার ও ধ্বংস করার চেষ্টা করবে। তবে সে সফল হবে না, কারণ দুই বৃহৎ আকারের ফেরেশতা দ্বারা শহরটি সুরক্ষিত থাকবে। এ কারণেই বলা হয়, দাজ্জাল আগমনের খবর পেলে আমাদের মদিনায় গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে।

(৪) নবিজি (সা) বলেছেন, “মদিনায় কখনো প্লেগের প্রাদুর্ভাব হবে না।” তারপর থেকে সেখানে কখনো প্লেগ দেখা যায়নি। এমনকি ১৯১৮ সালের ‘স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা’ যা বিশ্বের বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছিল, তাও মদিনাকে স্পর্শ করেনি। এটা বিস্ময়কর। কারণ সারা পৃথিবী থেকেই মানুষ মদিনায় আসে, তবুও সেখানে প্লেগ প্রবেশ করেনি।

(৫) মদিনার জন্য নবিজি (সা) প্রার্থনা করেছিলেন: “হে আল্লাহ! আপনি আমাদের এই শহরে বরকত দিন।” সহিহ বুখারিতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছিলেন, “হে আল্লাহ! আপনার এক বান্দা ইব্রাহিম (আ) মক্কাকে ‘হারাম’ ঘোষণা করেছিলেন। আমিও তো আপনার একজন বান্দা। সুতরাং আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি, আপনি মদিনাকে ‘হারাম’ হিসেবে গ্রহণ করে নিন। এ কারণেই আমাদের ধর্মে মদিনা দ্বিতীয় হারাম হিসেবে বিবেচিত।

 

মদিনার বরকত | মদিনায় হিজরত থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

মদিনার বরকত | মদিনায় হিজরত থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

(৬) সহিহ বুখারিতে আরও বর্ণিত আছে, নবিজি (সা) বলেছেন, “হে আল্লাহ! মদিনায় পরিমাপের এককের ক্ষেত্রে বরকত দিন।” সেই দিনগুলোতে শসা, যব, খেজুর ইত্যাদি কিনলে ওজন করতে হতো। তাই নবিজির (সা) এই দোয়ার অর্থ হলো, ‘কেউ মদিনায় যে খাবার কিনবে তা হবে বরকতময়। এর অর্থ হলো, এখানকার খাবার আরও বেশি মানুষকে পরিতৃপ্ত করতে পারবে।

(৭) এক হাদিস অনুসারে, নবিজি (সা) বলেছেন, “হে আল্লাহ! আপনি মক্কাকে যে পরিমাণ বরকত নিয়েছেন, মদিনাকে তার দ্বিগুণ বরকত দান করুন।” এই হাদিসটি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সমস্যা আছে। কারণ প্রশ্ন আসবে, তাহলে কি চেয়ে মদিনা বেশি বরকতময়? ইমাম মালিকসহ কিছু ক্লাসিক্যাল পণ্ডিত মদিনাকে পবিত্রতম স্থান বিবেচনা করতেন, যদিও মক্কায় ইবাদত করার পুরস্কার বেশি। সেইসব পণ্ডিতের মতে, এই হাদিসের কারণেই মদিনা শহর বেশি বরকতময়।

তবে অধিকাংশ পণ্ডিতের মত অনুসারে, প্রতিটি শহরই নিজস্ব মানদণ্ডে বরকতময়; এ ক্ষেত্রে তুলনা করা ঠিক নয়। কয়েকটি বিবেচনায় মক্কার শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠ পণ্ডিতের মত অনুসারে, আল্লাহ তায়ালা যেদিন নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন, সেদিনই মক্কাকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। মক্কার শ্রেষ্ঠত্বের আরেকটি দিক হলো, এখানেই পৃথিবীর বুকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য প্রথম ঘর (কাবা) নির্মিত হয়েছিল। অন্যদিকে নবিজির (সা) হিজরতের মধ্য দিয়ে মদিনা মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়। মূল কথা হলো, প্রত্যেক স্থানেরই আলাদা আলাদা ফজিলত ও বরকত রয়েছে।

 

bn.islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

(৮) নবিজি (সা) বলেছেন, “মরুভূমিতে প্রাণীরা যেমন গর্তে ফিরে আসে, তেমনি ইমানও মদিনায় ফিরে আসে।” এটি একটি সুন্দর উপমা। মরুভূমির প্রাণী নিরাপত্তার অভাব বোধ করলে যেমন গর্তে আশ্রয় নেয়, তেমনি মুমিনদের ওপর যখন আঘাত আসে (অর্থাৎ যখন ইসলাম সংকটের মুখোমুখি হয়), তখন ইমান সুরক্ষিত রাখার স্থান হিসেবে তাঁরা মদিনাকে বেঁছে নেন। অর্থাৎ, মদিনা ইসলামের জন্য দুর্গ, নিরাপদ আশ্রয়স্থল।

(৯) মদিনা শত্রুদের চক্রান্ত থেকে সব সময়ই রক্ষা পাবে। সহিহ বুখারিতে উল্লিখিত হাদিস অনুসারে, নবিজি (সা) বলেছেন, “কেউই মদিনার ক্ষতি করার ষড়যন্ত্র করতে পারবে না। করলে আল্লাহ তায়ালা তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন, যেভাবে পানিতে লবণ দ্রবীভূত হয়। “

(১০) সহিহ বুখারির হাদিসে আছে, নবিজি (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মদিনায় কোনো অপরাধ করবে কিংবা মদিনায় কোনো অপরাধীকে সহায়তা করবে, তার ওপর আল্লাহর, ফেরেশতাদের এবং সমগ্র মানবজাতির ‘লানত’ বর্ষিত হবে। আল্লাহ তার কাছ থেকে কোনো ফরজ কিংবা নফল আমল গ্রহণ করবেন না।” এটা যেমন মদিনার জন্য বিশাল বরকতের বিষয়, তেমনি যারা এই শহরের ক্ষতি করতে চায় তাদের জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা।

(১১) মদিনা বসবাসের জন্যও একটি বরকতপূর্ণ স্থান। নবিজি (সা) বলেছেন, যা সহিহ বুখারিতে বর্ণিত আছে, “মদিনা তাদের জন্য একটি উত্তম স্থান, যদি তারা তা জানত। আর যে মদিনায় থাকার অসুবিধাগুলো ধৈর্যের সঙ্গে মেনে নেবে, কেয়ামতের দিন আমি তার জন্য সুপারিশকারী হব।” উল্লেখ্য, মদিনার আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন; হয় খুব গরম, নয় খুব ঠান্ডা। আধুনিক প্রযুক্তির আগে এখানে শুধু মৌসুমি খাবারগুলো পাওয়া যেত।

 

মদিনার বরকত | মদিনায় হিজরত থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

(১২) মৃত্যুর স্থান হিসেবেও এই শহরটি বরকতপূর্ণ। মুসনাদ ইমাম আহমদের বর্ণনা অনুসারে, নবিজি (সা) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে যে মদিনায় মৃত্যুবরণ করতে সক্ষম হয়, সে যেন তা করে; কারণ আমি কেয়ামতের দিন তার জন্য সুপারিশ করব।” মদিনায় মৃত্যু বড় আশীর্বাদের বিষয়। উমর (রা) একটি অন্যরকম দোয়া করতেন, “হে আল্লাহ! আমি শহিদ হিসেবে মরতে চাই, এবং আমি মদিনায় মরতে চাই।” যেহেতু সেই সময় মদিনায় জেহাদের সুযোগ ছিল না, তাই সেখানে কোনো যুদ্ধ ছিল না। তাই তাঁর পুত্র ইবনে উমর এ নিয়ে ঠাট্টা করে বলতেন, “হে আমার পিতা! আপনি এই দুটি বিষয় কীভাবে একত্রিত করবেন?” কিন্তু আল্লাহ উমরের (রা) এই দোয়া কবুল করেছিলেন। তিনি মদিনাতেই শহিদ হন।

(১৩) বাকি আল-ঘরকাদ (জান্নাতুল বাকি কবরস্থান) মদিনাতে অবস্থিত। এটি বিশ্বের সর্বাধিক বরকতপূর্ণ কবরস্থান। ইবনে হাজার বলেছেন, নবিজির (সা) নয়জন স্ত্রীসহ প্রায় ১০ হাজার সাহাবিকে সেখানে দাফন করা হয়েছে। সেখানে কবর রয়েছে নবিজির (সা) পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্র এবং ফুপু সাফিয়ার। উসমান ইবনে আফফান (রা), ইমাম মালিক ও অন্যান্য তাবেয়িসহ অনেক আলেমকে এই কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে। একদিন আয়েশা (রা) ঘুম থেকে উঠে দেখলেন নবিজি (সা) ঘরে নেই। কিছু সময় পরে নবিজি (সা) ফিরে এসে বললেন, “জিব্রাইল (আ) মধ্যরাতে আমার কাছে এসে বলেছিলেন, আমি যেন বাকি আল-ঘরকাদে গিয়ে সেখানে কবরস্থ মানুষদের জন্য প্রার্থনা করি।”

আরও পড়ূনঃ

Leave a Comment