নবিজির সা ওপর নির্যাতন | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন, আমরা জানি, কুরাইশরা শুধু সাহাবি ও ইসলাম গ্রহণকারীদেরই নির্যাতন করেনি, নবি করিমের (সা) ওপরেও অনেক মানসিক নিপীড়ন চালিয়েছিল।
নবিজির সা ওপর নির্যাতন | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

কিন্তু তাঁকে কি শারীরিকভাবেও নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল? হলে তা কীভাবে? মুসলিমদের মধ্যে যারা কুরাইশ ছিলেন তাঁদের জন্য নিজ নিজ গোত্র থেকে নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ব্যবস্থা ছিল বটে, তবে তা সত্ত্বেও তাঁরা সব সময় সম্পূর্ণ সুরক্ষা পাননি। নবিজিকেও (সা) শারীরিকভাবে নির্যাতন সইতে হয়েছিল। তিনি কখনও কখনও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার তরফ থেকে সুরক্ষা পেয়েছেন, কখনও কখনও পাননি । নবিজিকে (সা) যেসব নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল তার কয়েকটি উদাহরণ:
১) আৰু জেহেল আল-লাত ও আল-উজ্জার কসম খেয়ে গর্ব করে অন্য কুরাইশদের বলেছিল যে, পরের বার যখন সে মুহাম্মদকে (সা) সেজদারত অবস্থায় দেখবে, তখন সে তাঁর গলায় পা দিয়ে চাপা দেবে এবং তাঁর ওপরে বালু নিক্ষেপ করবে।
সেই সময় নবিজি (সা) ও হাতেগোনা কয়েকজন মুসলিম কাবার সামনে নামাজ পড়তেন। আবু হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেছেন, একদিন নবিজি (সা) কাবায় নামাজ পড়ছিলেন। তাঁকে দেখতে পেয়ে আবু জেহেল তাঁর গলায় পা দিয়ে চাপা দেওয়ার জন্য এগিয়ে গেল কিন্তু নবিজির (সা) কাছ পর্যন্ত যাওয়ার আগে হঠাৎ করেই সে পেছন দিকে হাঁটতে শুরু করল এবং হাত দিয়ে সামনে বাতাসকে ঠেলাঠেলি করতে লাগল। সেখানে উপস্থিত লোকেরা তা দেখে আবু জেহেলকে জিজ্ঞেস করল তার কী হয়েছে।
আবু জেহেল বলল, সে দেখতে পেয়েছে, তার ও মুহাম্মদের (সা) মাঝখানে একটি আগুনের কূপ; আগুনের শিখার ওপরে কিছু ডানা নড়াচড়া করছিল। পরে নবিজি (সা) এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে সাহাবিদের বলেন, ফেরেশতারা সেখানে আগুন নিয়ে এসেছিল; আবু জেহেল যদি আর এক ধাপও এগিয়ে যেত, তাহলে ফেরেশতারা তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলত। আল্লাহ তায়ালা সুরা আলাকের শেষাংশে ঘটনাটি এইভাবে প্রকাশ করেন।
“তুমি কি সে (দাম্ভিক) ব্যক্তিটিকে দেখেছ যে (তাকে) বাধা দেয় এক বান্দাকে যখন সে নামাজ আদায় করে? তুমি কি দেখেছ সে সঠিক পথের ওপর আছে? অথবা সে কি তাকওয়ার আদেশ দেয়? সে ব্যক্তি সম্পর্কে তুমি কি মনে কর যে (আল্লাহকে) মিথ্যা প্রতিপন্ন করে এবং (তাঁর থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয়; এ দাম্ভিক লোকটি কি জানে না আল্লাহ তায়ালা (তার সবকিছুই) পর্যবেক্ষণ করছেন?
কিছুতেই না! যদি সে (এ থেকে) বিরত না হয়, তাহলে অবশ্যই তাকে আমি তার মাথার সামনের চুল ধরে তাকে টান দেব, এই লোকটি হচ্ছে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী নাফরমান ব্যক্তি। অতএব (বাঁচার জন্য আজ সে তার সঙ্গীসাথিদেরকে ডেকে আনুক! আমি অচিরেই তার জন্যে (আজাবের ফেরেশতাদের ডাক দেব। না, তুমি কিছুতে তার অনুসরণ করো না; তুমি তোমার মালিকের সামনে সেজদাবনত হও এবং তাঁর নৈকট্য লাভ করো।” [* সেজদার আয়াত] [৯৬:৯-১৯]
২) সহিহ বুখারিতে বর্ণিত আছে, উরওয়া ইবনে জুবায়ের একদিন আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আসকে জিজ্ঞেস করেন: নবিজি (সা) সবচেয়ে খারাপ কোন পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন? আবদুল্লাহ ইবনে আমর বর্ণনা করেন, একবার নবিজি (সা) কাবাঘরে নামাজ পড়ছিলেন। উকবা ইবনে আবি মুআত তখন সেখানে হাজির হয়। উকবা ছিল ইসলামের নিকৃষ্টতম পাঁচজন শত্রুর মধ্যে একজন, কারও কারও মতে সে ছিল আবু জেহেলের চেয়েও জঘন্য।

সে পেছন থেকে নিজের পোশাক খুলে তা দিয়ে নবিজির (সা) ঘাড় পেঁচিয়ে তাঁকে শ্বাসরোধ করার উপক্রম করে। নবিজি (সা) নিজেকে ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করেন। আশেপাশের লোকজন থাকলেও তারা তাঁকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে যায়নি। অবশেষে আবু বকর (রা) খবর পেয়ে কাবায় ছুটে গিয়ে উকবাকে বাধা দিয়ে বলেন, “তুমি কি তাঁকে এই জন্য খুন করতে যাচ্ছ যে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার প্রতিপালক আল্লাহ?” আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এই ঘটনার প্রেক্ষিতে নিচের আয়াতটি নাজিল করেন।
আবু বকর যা বলেন, ঠিক সেই কথাগুলোই এই আয়াতে রয়েছে: “ফেরাউন-সম্প্রদায়ের একজন মুমিন ব্যক্তি যে নিজের ইমান গোপন করে। আসছিল, সে বলল, ‘তোমরা কি একজন লোককে (শুধু এজন্যই) খুন করতে চাও, যে সে বলে, ‘আল্লাহ আমার প্রতিপালক’, যদিও সে তোমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে এসেছে?” [সুরা গাফির 40:28]
৩) ইবনে মাসউদ (রা) নবিজির (সা) ওপর কুরাইশ নেতাদের মানসিক নির্যাতনের একটি বর্ণনা দিয়েছেন, যা সহিহ বুখারিতে লিপিবদ্ধ আছে: “একবার নবিজি (সা) কাবায় নামাজ আদায় করছিলেন। আবু জেহেল ও তার সঙ্গীরা আশেপাশেই বসে ছিল। আবু জেহেল তার লোকদেরকে জিজ্ঞেস করল, “কে আছ যে একটি উটের নাড়িভুঁড়ি এনে মুহাম্মদ (সা) যখন তার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে থাকবে তখন তাঁর পিঠের ওপর ফেলতে পারবে?” এ কথা শুনে তাদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি উকবা ইবনে আবি মুআত চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করল।
সে একটি মৃত উটের নাড়িভুঁড়ি টেনে বের করে এনে সেজদারত নবিজির (সা) পিঠের ওপর ফেলে দিল। নাড়িভুঁড়ির ওজন এতই বেশি ছিল যে, নবিজি (সা) সেজদা থেকে মাথা তুলতে পারছিলেন না। এই দৃশ্য দেখে আশেপাশের লোকেরা হাসাহাসি শুরু করল। আমি দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, কিন্তু আমার নবিজিকে (সা) সাহায্য করার কোনো উপায় ছিল না (করলে আমাকে মেরে ফেলা হতো)। [ইবনে যেহেতু ভৃত্য শ্রেণির ছিলেন, তাই তিনি কিছু করতে সক্ষম হননি ।]
নবিজি (সা) ওভাবেই সেজদারত অবস্থায় ছিলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ। একজন গিয়ে তাঁর আট বছর বয়সী কন্যা ফাতেমাকে বলে, ‘তোমার বাবাকে সাহায্য করা দরকার।’ ফাতেমা এ কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গিয়ে বাবার পিঠের উপরের নাড়িভুঁড়িগুলো সরিয়ে ফেলতে সহায়তা করেন। নবিজি (সা) উঠে ওই লোকদের মুখোমুখি হয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে আঙুল তুলে তাদের বিরুদ্ধে প্রত্যেকের নাম ধরে ধরে দোয়া করেন। তাঁকে এই মূর্তিতে দেখে কুরাইশদের চেহারা ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। নবিজি (সা) তাদের প্রত্যেকের নাম তিনবার উল্লেখ করেন। যাদের বিরুদ্ধে তিনি দোয়া করেন। তারা হলো:
১। আৰু জেহেল ইবনে হিশাম
২। উতবা ইবনে রাবিয়া ৩। ইবনে রাবিয়া
৪। ইবনে উকবা ৫। উমাইয়া ইবনে খালাফ
৬। উকবা ইবনে আবি মুআত
[ সপ্তম নামটি ইবনে মাসউদ স্মরণ করতে পারেননি ইবনে মাসউদ (রা) ঘটনার বর্ণনা শেষে বলেন, “আমি আল্লাহর নামে কসম খেয়ে বলছি, আমি নিজে বদরের যুদ্ধে এই সাতজনের প্রত্যেককেই নিহত হয়ে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকতে দেখেছি। রোদের প্রচণ্ডতা তাদের দেহগুলোকে বিকৃত করে দিয়েছিল। সেই দিনটিতে আসলেই প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। আমি তাদের দেহগুলো টেনে নিয়ে গিয়ে বদরের কূপের মধ্যে ফেলেছিলাম।” এভাবেই আল্লাহ ইসলামের প্রথম যুদ্ধেই ওই সাতজনের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।

৪) ইসলামের দাওয়াতের অষ্টম-নবম বছরে নবিজিকে (সা) হত্যার পরিকল্পনা শুরু হয়। ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অনুসারে, এক প্রতিবেশী নারী ফাতেমাকে বলেন, কুরাইশরা তাঁর বাবাকে হত্যার জন্য পরিকল্পনা করছে। নবিজি (সা) ফাতেমার কাছ থেকে তা জানতে পেরে বলেন, “ভয় কোরো না। আল্লাহ তায়ালা আমাকে রক্ষা করবেন। তুমি বরং আমাকে পানি এনে দাও।”
তারপর তিনি ওজু করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নিকট দোয়া করেন এবং কাবা এলাকায় যান। কুরাইশরা সেখানে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাঁকে হত্যা করার জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু তাকে দেখে কেউই আর নড়াচড়া করতে পারেনি, সবাই অসাড় হয়ে পড়ে। নবিজি (সা) কিছু বালি নিয়ে বসে থাকা লোকদের মুখের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলেন, “এই মুখগুলো অভিশপ্ত হোক।” যে সাহাবি এই ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন, তিনি আরও বলেছেন, বদরের যুদ্ধে এই লোকদের প্রত্যেকেই খুন হয়েছিল।
আরো পড়ূনঃ
