বনু কুরায়জার পক্ষ পরিবর্তন | খন্দকের (আহজাবের) যুদ্ধ-৩ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

বনু কুরায়জার পক্ষ পরিবর্তন | খন্দকের (আহজাবের) যুদ্ধ-৩, বনু কুরায়জা কীভাবে মত পরিবর্তন করেছিল সে বিষয়ে ইবনে ইসহাক সূত্র উল্লেখ না করেই বর্ণনা করেছেন: হুয়ায় যে আসছে সেই খবর বনু কুরায়জার কাছে পৌঁছার পর তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে। কারণ তারা আঁচ করতে পারছিল যে, বনু নাদির তাদের কাছে বিশ্বাসঘাতকতা করার প্রস্তাব দিতে পারে। তাই হুয়ায় এলে বনু কুরায়জার নেতা কাব ইবনে আসাদ প্রথমে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বসে ছিল। হুয়ায় দরজায় কড়া নেড়ে বলল, “হে কাব, আমাকে ভেতরে ঢুকতে দাও।”

বনু কুরায়জার পক্ষ পরিবর্তন | খন্দকের (আহজাবের) যুদ্ধ-৩ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

বনু কুরায়জার পক্ষ পরিবর্তন | খন্দকের (আহজাবের) যুদ্ধ-৩ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

কাব উত্তর দিল, “না। তুমি নিশ্চয়ই আমাদের জন্য অশুভ কিছু বয়ে নিয়ে এসেছ। আমরা তোমার সঙ্গে কোনো কথা বলতে চাই না। এখানে তোমার উপস্থিতি আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যের শামিল। মুসলিমরা যদি জানতে পারে যে তুমি এখানে এসেছ, তবে আমাদের সমস্যা হতে পারে। মুহাম্মদের সঙ্গে আমি চুক্তিবদ্ধ, সে চুক্তি আমি ভাঙতে পারব না। কারণ, সে সৎ এবং প্রতিশ্রুতি দিলে তা পালন করে।”`

কিন্তু নাছোড়বান্দা হুয়ায় বারবার অনুনয়বিনয় করে কড়া নেড়েই চলেছে। অবশেষে সে অন্য কৌশল অবলম্বন করে বলল, “আমার মনে হয় তোমার দরজা না খোলার একমাত্র কারণ তুমি আমাকে আপ্যায়ন করাতে চাও না। তুমি এতটা স্বার্থপর ও কৃপণ যে কাউকে একটু খাবারও দিতে চাও না।” হুয়ায়ের এই “ইমোশনাল ব্র্যাকমেইলে’ কাবের মন নরম হয়। তাই সে দরজা খুলে দেয়।

হুয়ায় ভেতরে ঢুকেই বলতে শুরু করে, “আমি তোমাদের সাহায্যার্থে অসংখ্য লোকবল নিয়ে এসেছি। কুরাইশ ও পাতাফানের নেতারাসহ তাদের সেনাবাহিনী, চাকরবাকর, দাসদাসী সবাই আমাদের সঙ্গে আছে। তারা আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যতক্ষণ না মুহাম্মদ ও তার সাহাবিদের নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে, ততক্ষণ তারা বাড়ি ফিরে যাবে না।”

ইবনে ইসহাক আরও বর্ণনা করেছেন, হুয়ায় সারা রাত কাবকে ফুসলাতে থাকে, “বাকিরা চলে গেলেও আমি তোমাদের সঙ্গেই আছি। তোমাদের যা হবে, আমারও তা-ই হবে।” হুয়ায় এই কথাটিই কাবকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছিল যে, এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু কাবের দ্বিধা তখনও কাটছিল না। সে বলল, “তোমার উপস্থিতি আমাদের জন্য মোটেই ভালো খবর নয়।”

 

bn.islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

তারপর সে আরবি ভাষায় প্রচলিত একটি রূপক ব্যবহার করে হুয়ায়কে আরও বলল, “তুমি তো এমন মেঘের মতো, যা দেখলে মনে হয় যে হয় অনেক বৃষ্টি হবে, কিন্তু কাছে এলে তা শুধু বিজলি আর বজ্রপাতই দেয়।” কাব মনের গভীরে বুঝতে পারছিল যে কাজটি ঠিক হচ্ছে না, তার বিবেক তাকে বারবার সতর্ক করছিল। তারপর কী হয়েছিল তা আমরা বিশদভাবে জানি না। কেবল এটুকু জানা যায় যে, হুয়ায় সারারাত ধরে চাপ দিতে দিতে সকালের দিকে একপর্যায়ে কাবকে পক্ষ পরিবর্তনের জন্য রাজি করাতে সক্ষম হয়। তারপর কাব নবিজির (সা) সঙ্গে সাক্ষর করা চুক্তিপত্রটি ছিড়ে ফেলে।

[আনুষঙ্গিক বিষয়: সেটি ছিল কাগজেকলমে সাক্ষর করা একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি। আমরা আগে উল্লেখ করেছি, নবিজি (সা) বনু কুরায়জার সঙ্গে কমপক্ষে তিনবার এই চুক্তি বলবৎ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন। নিশ্চিত করার সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছিল মাত্র কয়েক মাস আগে। সুতরাং বনু কুরায়জার ওপর এখন যদি কোনো শাস্তি নেমে আসে, তাহলে বিষয়টিকে প্রাসঙ্গিকতার মাপকাঠিতে দেখতে হবে। এমনকি কারও জানত যে, পক্ষ পরিবর্তনের সিদ্ধান্তটি অন্যায় এবং তা তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে।]

জুবায়ের ইবনুল আওয়ামের কাছ থেকে পাওয়া খবরের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য নবিজি (সা) যে চারজন জ্যেষ্ঠ আনসার সাহাবিকে পাঠিয়েছিলেন, তাঁরা ছিলেন: (১) সাদ ইবনে মুআদ (আউসের নেতা), (২) সাদ ইবনে উবাদা (খাজরাজের নেতা), (৩) আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা, এবং (8) খাওয়াত ইবনে জুবায়ের। তিনি তাঁদের বললেন, “আমাদের কাছে যে সংবাদ পৌঁছেছে তার সত্যতা তোমরা নিশ্চিত করবে। তা যদি সত্য হয়, তাহলে তা আমাকে পরোক্ষভাবে জানাবে, স্পষ্ট করে বলার প্রয়োজন নেই। সরাসরি এই খবর দিয়ে আমাদের লোকদের মনে ভয় ঢুকিয়ে তাদের দুর্বল করে দিও না। তবে তারা (বনু কুরায়জা) যদি এখনও চুক্তিতে অটল থাকে, তাহলে সেই খবর উচ্চস্বরে সবাইকে জানিয়ে দিও যাতে লোকজন (মুসলিমরা) মনে ভরসা পায়।”

 

বনু কুরায়জার পক্ষ পরিবর্তন | খন্দকের (আহজাবের) যুদ্ধ-৩ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন, ওই চার সাহাবি সেখানে গেলে বনু কুরায়জার লোকেরা তাঁদের সঙ্গে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ নানা কথাবার্তা বলতে থাকে। তারা এমনও বলে, “তোমরা যে আল্লাহর রসুলের কথা বলো, সে আবার কে?” “আমরা কোনো মুহাম্মদকে চিনি না; তার সঙ্গে আমাদের কোনো চুক্তি নেই।” এ ছিল ঐদ্ধত্য ও নীচতার এক চরম বহিঃপ্রকাশ। সাদ ইবনে মুআদ (রা) কিছুটা মেজাজী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি রেগে গিয়ে তাদের এমনভাবে  অভিশাপ দিতে থাকেন যা তারা আগে কখনও শোনেনি। বনু কুরায়জাও পাল্টা অভিশাপ দিচ্ছিল। এই পর্যায়ে সাদ ইবনে উবাদা (রা) সাদ ইবনে মুআদকে (রা) জড়িয়ে ধরে বললেন, “আমাদের ও তাদের মধ্যে যে সমস্যা, তা আর অভিশাপ দেওয়া-নেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।”

চার সাহাবি নবিজির (সা) কাছে ফিরে এসে ‘আদল’ ও ‘আল-কাররাহ’ নামের দুটি উপজাতির নাম বললেন, যারা ছিল আল-রাজি ও বির মাউনার ঘটনার জন্য দায়ী। আসলে তারা বনু কুরায়জার বিশ্বাসঘাতকতার খবরটি ইঙ্গিতের মাধ্যমে নবিজিকে (সা) জানিয়ে দিলেন। নবিজিকে (সা) শুনে বললেন, “আল্লাহু আকবার! সুসংবাদ!” নবিজির (সা) এই কথার দুটি অর্থ হতে পারে: (১) যেন সাহাবিদের মনে কোনো আতঙ্ক সৃষ্টি না হয়; (২) বনু কুরায়জার জমিজমা ও সম্পত্তি এখন মুসলিমদের হাতে আসবে।

আল্লাহ ভালো জানেন। তবে শেষ পর্যন্ত খবরটি গোপন রাখা যায়নি। খবরটি ছড়িয়ে পড়লে নবিজি (সা) টহলৱত সাহাবিদের মধ্যে থেকে জায়েদ ইবনে হারিসা ও সালামা ইবনে আসলামসহ একটি ছোট দলকে আল-ফারি দুর্গ সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব দিয়ে পাঠালেন। সেই সঙ্গে তিনি বনু কুরায়জাকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন যে, তাদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ

Leave a Comment