ওহি কীভাবে নাজিল হয় ? | দ্বিতীয়বারের ওহি , ওহি আসলে কী? তা কীভাবে নাজিল বা অবতীর্ণ হয়? কোনো ব্যক্তির ওপর ওহি নাজিল হলে বা কেউ অন্তঃপ্রেরণা পেলে কী হয়? ওহি বা অন্তঃপ্রেরণা হলো মানবজাতির সঙ্গে আল্লাহ তায়ালার সরাসরি যোগাযোগ।

ওহি কীভাবে নাজিল হয় ? | দ্বিতীয়বারের ওহি | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
ইবনুল কাইয়িমের বর্ণনা অনুসারে নবি করিমের (সা) কাছে সাতটি ভিন্ন উপায়ে ওহি আসত:
১) সত্য স্বপ্ন। ওহির সর্বনিম্ন রূপ হলো সত্য বা প্রকৃত স্বপ্ন। এটিই ওহির একমাত্র রূপ যা এখনও সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রযোজ্য। যে কোনো ব্যক্তি এমন সত্য স্বপ্ন দেখতে পারেন। নবিজি (সা) নবুয়তের আগে ও পরে সত্য স্বপ্ন দেখেছিলেন। সত্য স্বপ্ন শুধু নবিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।
২) জিব্রাইল ছাড়া অন্য ফেরেশতাদের মৃদুস্বরের কথন: আরবিতে বলা হয় ‘ইলহাম’। উদাহরণ হিসেবে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে মুসার (আ) মায়ের অন্ত ঃপ্রেরণাপ্রাপ্ত হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করা যায়। পবিত্র কোরানের সুরা কাসাসে আল্লাহ বলেছেন, “আমি মুসার মায়ের কাছে ওহি পাঠালাম …। [২৮:৭] এই ধরনের ওহি আসে অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিদের কাছে, আল্লাহ যাঁদের পছন্দ করেন। আরেক উদাহরণ ইসার (আ) মা মরিয়ম। অতএব এই জাতীয় অন্তঃপ্রেরণা কারো কাছে এলেই তিনি নবি হয়ে যান না। এগুলো ফেরেশতাদের মাধ্যমে আল্লাহর কাছ থেকে আসে। ফেরেশতারা এই ধরনের বার্তা ব্যক্তির হৃদয়ে সঞ্চারিত করে দেন।
৩) ফেরেশতা জিব্রাইলকে (রা) সামনাসামনি দেখতে পাওয়া এবং তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা বলা। কখনো কখনো সাহাবিরা তাঁকে দেখতে পেয়েছেন, কখনো কখনো দেখতে পাননি। এরকম অনেকবার ঘটেছে। নবিজির (সা) জীবনের মদিনা পর্বে জিব্রাইল (আ) যখন তাঁর কাছে আসতেন, তখন সাধারণত তিনি নিহিয়াহ আল-কালবি নামের এক আনসারি সাহাবির রূপ ধারণ করে উপস্থিত হতেন। নিহিয়াহকে সে সময় সাহাবিদের মধ্যে সর্বাধিক সুদর্শন বলে মনে করা হতো। অনেক সময় লোকে ভারত তাঁরা দিহিয়াকে দেখেছে; কিন্তু আসলে সে ছিল জিব্রাইল (রা)। আয়েশা (রা) নবিজিকে (সা) কয়েকবার দিহিয়াহর সঙ্গে কথা বলতে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “দিহিয়াহ আপনার কাছে কী চেয়েছিল?” জবাবে আল্লাহর রসুল (সা) বলেছিলেন, “সে দিহিয়াহ ছিল না, সে ছিল জিব্রাইল।” নবিজির (সা) পক্ষে এইভাবে ওহি গ্রহণ করা তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল।

৪) নবি করিম (সা) এক ধরনের মোহাবিষ্ট বা সম্মোহিত অবস্থায় চলে যেতেন, সেই অবস্থায় জিব্রাইল (আ) তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। নবিজি (সা) সে সময় মুখ নিচু করে থাকতেন, তাঁর চোখ মুদে আসত। আশেপাশে কী ঘটছে তা তাঁর স্বাভাবিক বোধের মধ্যে থাকত না। তিনি চলে যেতেন নিজের জগতে, ওহির রাজ্যে। এই অবস্থা সম্পর্কে আয়েশা (রা) বলেছেন, “আমি আল্লাহর রসুলকে (সা) একাধিকবার এমন অবস্থায় দেখেছি। এমনকি শীতের দিনে ওহি এলেও তিনি ঘেমে উঠতেন।”
নবিজির (সা) পক্ষে এই অবস্থা খুবই কষ্টসাধ্য হতো। সহিহ বুখারির অন্য একটি হাদিস অনুসারে, ‘সুরা মায়েদা যখন নাজিল হয়, নবি করিম (সা) সেই সময় একটা উটের ওপর বসে ছিলেন। সুরাটি এতটাই ভারী ছিল যে উটকে বসে পড়তে হয়েছিল।’ যেমন, পবিত্র কোরানে সুরা মুজাম্মিলে আল্লাহ বলেছেন, “(হে মুহাম্মদ), আমি তোমার কাছে একটি গুরুভার বাণী অবতীর্ণ করতে যাচ্ছি।” [৭৩:৫) অন্য এক হাদিস অনুসারে, নবিজি (সা) একদিন এক সাহাবির কোলের ওপর ভর দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।
এমন সময় ওহি নাজিল হওয়া শুরু হয়। তখন সাহাবিটির মনে হচ্ছিল যেন তাঁর উরুর হাড় ফেটে যাবে। সহিহ বুখারির বর্ণনায় আছে, হাকিম ইবনে হিজাম নবিজিকে (সা) জিজ্ঞেস করেছিলেন, “হে আল্লাহর রসুল! আপনার কাছে ওহি কীভাবে আসে?” জবাবে নবিজি (সা) বলেন, “কখনো কখনো জিব্রাইল (আ) একজন মানুষের রূপ ধরে আমার কাছে আসে, আমি তখন তার বক্তব্য বুঝতে পারি। আবার কখনো কখনো তিনি আমার মাঝে এমনভাবে আসেন যেন আমি ঘণ্টাধ্বনি মতো একটি শব্দ শুনতে পাই। যদিও এটি আমার জন্য বেশি কষ্টকর, তবু তিনি আমাকে যা বলেন তা আমি বুঝতে পারি।”

৫) নবিজি (সা) জিব্রাইলকে (আ) তাঁর আসল (ফেরেশতার) আকারে বা রূপে দেখতে পেতেন। এটা কতবার ঘটেছে তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে অন্তত দুইবারের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। একবার ইকরা (প্রথম ওহি নাজিলের সময়, আরেকবার ইসরা ওয়া আল-মিরাজের যাত্রার সময়। জিব্রাইলের (আ) আসল আকার ও রূপ কেমন? আমাদের জানা মতে, তিনি এত বড় ছিলেন যে তাঁর অবয়বে দিগন্ত ঢাকা পড়ে যেত। তাঁর ৬০ হাজার ডানা রয়েছে যা অন্য যে কোনো ফেরেশতার চেয়ে বেশি।
৬) আল্লাহর কাছ থেকে সরাসরি প্রাপ্ত ওহি। ইবনুল কাইয়িম উল্লেখ করেছেন, আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসুলকে (সা) কোনো ফেরেশতার মধ্যস্থতা ছাড়াই সরাসরি তাঁর মনে ওহি সঞ্চারিত করেছিলেন। এটি কখন এবং কীভাবে ঘটত তা নিয়ে বিতর্ক আছে; তাই এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। এই বিষয়টির সমর্থনে তেমন কোনো উদাহরণও আমাদের জানা নেই। আল্লাহ তায়ালা ভালো জানেন। ৭) সম্ভাব্য সর্বোচ্চ পর্যায়ের ওহি। আল্লাহর সরাসরি ‘কালাম’ বা কথা। এটি শুধু একবারই ঘটেছিল, যখন নবিজি (সা) মিরাজে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে গিয়েছিলেন। সেখানে আল্লাহ তাঁর রসুলের (সা) সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন, এমনকি জিব্রাইলও (আ) সেখানে উপস্থিত ছিলেন না।
এর বেশি আর যাওয়ার অনুমতি আমার নেই।” নবিজি (সা) এমন এক জায়গা পর্যন্ত গিয়েছিলেন, যেখান থেকে তিনি লেখকদের লেখার শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। সেখানে তিনি আল্লাহ আজ্জা ওয়াজালের হিজাব (আলোর পর্দা) দেখতে পেয়েছিলেন। এই সময়ই আল্লাহ তাঁর রসুলের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছিলেন, যেমন করে তিনি কথা বলেছিলেন মুসার (আ) সঙ্গে। তবে আমাদের নবি মুহাম্মদের (সা) সঙ্গে কথা বলার বিষয়টির গুরুত্ব ও মর্যাদা বেশি ছিল। আল্লাহ তায়ালা মুসার (আ) সঙ্গে তুর পাহাড়ের ওপর কথা বলেছিলেন, কিন্তু তিনি মহানবি মুহাম্মদের (সা) সঙ্গে কথা বলেছিলেন তাঁকে সাত আকাশের ওপরে ডেকে ।
আরো পড়ুনঃ
