সুরাকা ইবনে মালিকের রূপ ধরে ইবলিসের আগমন | বদরের যুদ্ধ-২, কুরাইশরা যখন মক্কা ত্যাগ করেছিল তখন তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১,৩০০। এটা ছিল কুরাইশদের ইতিহাসে তখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় বাহিনী।
সুরাকা ইবনে মালিকের রূপ ধরে ইবলিসের আগমন | বদরের যুদ্ধ-২ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
কুরাইশরা কখনোই একতাবদ্ধ ছিল না; তারা সর্বদাই নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত ছিল। আল্লাহ তায়ালা কোরানেও সে সাক্ষ্যই দিচ্ছেন: “তুমি মনে কর ওরা ঐক্যবদ্ধ, কিন্তু ওদের মনের মিল নেই।” [সুরা হাশর, ৫৯:১৪] বদরের জন্য মক্কা থেকে বের হওয়ার সময় তাদের এই বিভেদ প্রকট রূপে প্রকাশ পেল। তাদের মধ্যে এক দল অনেক পুরানো একটি শত্রুতার প্রসঙ্গ এনে বলল, “আমরা কি মক্কা অরক্ষিত অবস্থায় ছেড়ে যাচ্ছি?” অতীতের শত্রুতার মূলে ছিল কুরা’ইশ ও বনু বকর গোত্রের মধ্যে একটি সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া একটি ছোটখাট যুদ্ধ।
কাহিনিটি দীর্ঘ, সংক্ষেপে বলতে গেলে তা ছিল এরকম: একবার এক নেতাগোছের কুরা’ইশ যুবক বনু বকর উপজাতির এলাকায় গিয়েছিল। ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অনুসারে সে ছিল লম্বা ও সুদর্শন। বনু বকরের নেতা তাকে দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে নিজের উপজাতির একজনকে বলে যুবকটিকে হত্যা করতে হবে, একদম কোনো কারণ ছাড়াই।

এই ঘটনার বহু বছর আগে বনু বকরের একজনকে এক কুরা’ইশ হত্যা করেছিল। বনু বকরের নেতা সেই পুরানো ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে বলে, “আমি পুরানো হত্যার বদলা নিতে এই যুবককে হত্যা করতে যাচ্ছি।” কুরা’ইশরা একজন প্রতিনিধি পাঠিয়ে হত্যার কারণ জানতে চাইলে বনু বকরের নেতা বলে, “একজনের বদলে আরেকজন। মনে আছে, তোমরা অনেক অনেক আগে আমাদের গোত্রের একজনকে হত্যা করেছিলে? সেই পুরানো হত্যার বদলা নিতে আমরা তোমাদের এই যুবককে হত্যা করেছি। আমাদের দুপক্ষের মধ্যে এখন শোধ হয়ে গেছে। চলো, আমরা এ-বিষয় নিয়ে আর কিছু না করি।”
কুরা’ইশরা ভাবল, “ঠিক আছে, আমরা যুদ্ধে যাব না। একজনের বদলে আরেকজন! আমরা যে তাদের একজনকে হত্যা করেছিলাম সে জন্য তো রক্তঋণ শোধ করিনি।” কিন্তু সমস্যা দেখা দিল, সেই নিহত যুবকটির ভাই বনু বকরের নেতাকে হত্যা করে ফেলল। শুধু তাই নয়, সে মৃতদেহটি টুকরো টুকরো করে কেটে মক্কায় এনে তা কাবার দরজায় ঝুলিয়ে দিল। তারপর খুব দ্রুত এমন কথা ছড়িয়ে পড়ল যে কুরা’ইশরা বনু বকরের নেতাকে হত্যা করেছে। এ নিয়ে গৃহযুদ্ধ বাধার উপক্রম হলো। কিন্তু সেই সময় ইসলামও বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তাই মুসলিমদের আগে মোকাবেলা করার জন্য দুই উপজাতি তাদের যুদ্ধে বিরতি দিয়েছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে সমস্যা তো মেটেনি, বরং অনেকটা অচলাবস্থার মধ্যে ছিল।

কুরা’ইশরা বদরের উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে রওনা হলেও বনু বকরের সঙ্গে বিরোধের বিষয়টি তাদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। তাদের মনে চিন্তা হলো, ‘মক্কা খালি হয়ে গেলে বনু বকর আক্রমণ করবে, আমাদের নারীদের ধরে নিয়ে যাবে, সন্তানদের হত্যা করবে, আমাদের সম্পত্তি দখল করে নেবে; এভাবে তারা প্রতিশোধ নেবে।’ এই বিষয় নিয়ে কুরা’ইশ বাহিনীতে বিশাল হইচই বেধে গেল । যারা যুদ্ধে যেতে চায় না, তারাও যুদ্ধে না যাওয়ার জন্য কোনো না কোনো অজুহাত চায়। ফলে কুরাইশ বাহিনীর এক বিশাল অংশ মক্কায় ফিরে যেতে উদ্যত হলো।
এই পরিস্থিতিতে ইবলিস মরিয়া হয়ে ওঠে। সে সুরাকা ইবনে মালিকের রূপ ধরে কুরাইশদের কাছে নিজেই শারীরিকভাবে উপস্থিত হয়, আল্লাহ যা কোরানেও উল্লেখ করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে, সুরাকা হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে হিজরতের সময় পুরস্কারের আশায় নবিজিকে (সা) পথে আটক করার চেষ্টা করেছিল। উল্লেখ্য, তখন পর্যন্ত সে মুসলিম হয়নি। সে ইসলাম গ্রহণ করেছিল আরও পরে, ৮ম হিজরি সালে ।
ইবলিস সুরাকার রূপ ধরে উপস্থিত হওয়ার পেছনে কারণ হলো, সুরাকা বনু কিনানার বংশোদ্ভূত ছিল। বনু বকর ছিল বনু কিনানা উপজাতির সবচেয়ে বড় গোত্র, যেমনটি বনু হাশিম কুরাইশ উপজাতির একটি গোত্র। অর্থাৎ বনু কিনানা আর কুরাইশ সমতুল্য। আর সুরাকা ছিল বনু কিনানার আরেকটি গোত্রের নেতা। সুতরাং ইবলিস সুরাকার রূপ ধরে এসে বলে, “একটুও চিন্তা কোরো না। আমি তোমাদের দুশ্চিন্তার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছি। আমি নিশ্চিত করব, বনু বকর তোমাদের আক্রমণ করবে না। আমি তোমাদের রক্ষা করব। তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করতে পার।” সে আরও বলে, “আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব (যুদ্ধে গিয়ে লড়াই করব), যাতে তোমরা বুঝতে পার যে আমি সিরিয়াস।” বনু কিনানার একজন নেতার এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে কুরাইশরা আশ্বস্ত হয় ।

কুরাইশ বাহিনীর আকার
মুসনাদে ইমাম আহমদ ও ইবনে ইসহাক প্রমুখের বর্ণনা অনুসারে, আবু জেহেলের নেতৃত্বে কুরাইশ বাহিনীতে ১,৩০০ লোক ছিল। এছাড়া তাদের ১০০টির বেশি ঘোড়া, ৬০০টির বেশি বর্ম এবং আনুমানিক ৫০০টি উট ছিল। উটগুলো শুধু চড়ার জন্যই ছিল না, খাবার হিসেবে ব্যবহার করার জন্যও নেওয়া হয়েছিল । জানা যায়, তারা প্রতিদিন ১০টি করে উট জবাই করত। এমনকি তারা কিছু নারীকেও সঙ্গে নিয়েছিল, যারা গান গেয়ে গেয়ে তাদের মনোবল বাড়াতে চেষ্টা করত।
এই বিষয়টি আল্লাহ তায়ালা কোরানে উল্লেখ করেছেন: “আর তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা গর্বভরে ও লোক-দেখানোর জন্য নিজ ঘর থেকে বের হয় এবং (লোককে) আল্লাহর পথে বাধা দেয়। তারা যা করে আল্লাহ তা ঘিরে রয়েছেন (তা সম্পর্কে অবহিত আছেন)।” [সুরা আনফাল, ৮:৪৭] উপরে উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ তাদের মনস্তাত্ত্বিক দিকটি বর্ণনা করেছেন: মক্কা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তারা বেশ উজ্জীবিত ভাব দেখাতে চাইছে, সবাইকে জানিয়ে দিতে চাইছে যে তারা আরব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এক বাহিনী নিয়ে এগিয়ে চলেছে ।
আরও পড়ুনঃ
