আবুল আস ইবনুল রাবির কাহিনি | খন্দক ও হুদায়বিয়ার মাঝে ছোট ছোট অভিযান, আবুল আস ইবনুল রাবি ছিলেন বনু আবদ শামস গোত্রের একজন বিশুদ্ধ কুরাইশ। তার মা হালা ছিলেন খাদিজার (রা) বড় বোন। সেই সম্পর্কে আবুল আস ছিলেন জয়নবের আপন খালাত ভাই। নবুয়তের আগে খাদিজা (রা) নবিজিকে (সা) অনুরোধ করেছিলেন জয়নবকে তাঁর বোনের ছেলে আবুল আসের সঙ্গে বিয়ে দিতে। নবিজি (সা) কখনও খাদিজার কোনো কথা প্রত্যাখ্যান করেননি। তিনি আবুল আসের সঙ্গে জয়নবের বিয়ে দেন।
আবুল আস ইবনুল রাবির কাহিনি | খন্দক ও হুদায়বিয়ার মাঝে ছোট ছোট অভিযান | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

নবিজি (সা) ইসলাম প্রচার শুরু করলে কুরাইশরা আবুল আসকে চাপ দিচ্ছিল এই বলে, “তুমি কোন নারীকে চাও তার নাম বলো, আমরা তার সঙ্গেই তোমাকে বিয়ে দেব। কিন্তু জয়নবকে ছেড়ে দাও (তালাক দাও)।” আবুল আস তাদের কথায় কর্ণপাত না করে বলতেন, “জয়নবের স্থান কেউ নিতে পারবে না।” তিনি স্ত্রীকে এতই ভালোবাসতেন যে কুরাইশদের ওই প্রলোভনে সাড়া দেননি। নবিজি (সা) মদিনায় হিজরত করার সময় জয়নব স্বামীর সঙ্গে মক্কায় রয়ে যান।
[উমামা নামে জয়নবের একটি কন্যাসন্তান ছিল। সহিহ বুখারির বর্ণনা অনুসারে, নবিজি (সা) এই উমামার সঙ্গে খেলতেন এবং তাকে কোলে নিয়ে কখনও কখনও নামাজও আদায় করতেন। জয়নবের একটি পুত্র সন্তানও ছিল, কিন্তু শিশু অবস্থাতেই সে মারা যায়। তবে উমামা বেশ দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন। পরে তাঁর খালা ফাতেমার মৃত্যুর পর তিনি আলি ইবনে আবি তালিবকে (রা) বিয়ে করেন এবং তাঁদের কয়েকজন সন্তানও হয়।]
যা-ই হোক, জায়েদের সারিয়া থেকে আবুল আসকে যে সময়ে বন্দি করা হয়, তখনও তিনি জয়নবের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। এর আগে তিনি নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বদরের যুদ্ধে কুরাইশদের পক্ষে অংশ নিয়ে বন্দি হয়েছিলেন। নবিজি (সা) তখন আবুল আসের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নেন যে, তিনি মক্কায় ফিরে গিয়ে জয়নবকে মদিনায় পাঠিয়ে দেবেন। সে এক দীর্ঘ কাহিনি। শেষ পর্যন্ত আবুল আস জয়নবকে মদিনায় পাঠিয়ে প্রতিশ্রুতি পূরণ করেন (কাহিনিটি ৪১তম পর্বের শেষের দিকে ‘বদরের যুদ্ধের প্রভাব’ অধ্যায়ে আলোচনা করেছি)।
এ কারণে আবুল আসের প্রতি নবিজির (সা) এক ধরনের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল। সহিহ বুখারিতে উল্লেখ আছে, নবিজিকে (সা) তাঁর জামাতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, “আবুল আস আমার কাছে সত্য কথা বলেছিল, “সে আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং সে তা পূরণ করেছে।” বদরের যুদ্ধের সেই ঘটনার ৩-৪ বছর পর এখন তিনি আবারও যুদ্ধবন্দি হিসেবে মদিনায়।

পরের দিন সকালে ফজরের নামাজে নবিজি (সা) তাকবির (আল্লাহু আকবার) বলার সঙ্গে সঙ্গে নারীদের দিক থেকে উচ্চস্বরে আওয়াজ ভেসে এল, “হে মুসলিমগণ, আমি জয়নব বিনতে মুহাম্মদ। আমি আবুল আস ইবনুল রাবিকে আমার সুরক্ষা দিয়েছি। আপনারা তাঁকে সুরক্ষা দিন।” সেখানে নামাজে দাঁড়ানো সবাই জয়নবের কথাগুলো শুনতে পেলেন। নবিজি (সা) নামাজ শেষে উপস্থিত সাহাবিদের জিজ্ঞেস করলেন, “আমি যা শুনেছি তোমরাও কি তা শুনেছ?” সাহাবিরা বললেন যে তাঁরা তা শুনেছেন।
তখন নবিজি (সা) বললেন, “আল্লাহর কসম, তোমাদের মতোই আমারও এ বিষয়ে কোনো ধারণা নেই (অর্থাৎ জয়নব যা বলেছেন তা সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই; তোমরা যতটা অবাক হয়েছ, আমিও ঠিক ততটাই অবাক হয়েছি)। ” এরপর নবিজি (সা) সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেন: “সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে সব মুসলিমই সমান; তাদের যে কেউ অন্য কাউকে তা দিতে পারে। অতএব, হে জয়নব, তুমি যাকে সুরক্ষা দিয়েছ, আমরাও তাকে সুরক্ষা দেব।”
তারপর নবিজি (সা) সাহাবিদের মধ্যে যারা আবুল আসকে বন্দি করে এনেছিলেন তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন। তিনি তাদের বললেন, “যা ঘটেছে তার সবই তো তোমরা দেখেছ। তা ছাড়া তোমরা তো আমার পরিবারে আবুল আসের অবস্থান (সে যে জয়নবের স্বামী) সম্পর্কেও জানো। তাই তোমরা যদি চাও, তাহলে তার অর্থকড়িসহ কাফেলায় তার সম্পদের অংশটুকু তাকে ফেরত দিতে পার। তাহলে তা আমাদের (আমার পরিবারের) কাছে বেশি পছন্দনীয় হবে । আর তোমরা যদি এসব রেখে দিতে চাও, তাহলে তা তোমাদের অধিকারের মধ্যে পড়ে, যা আল্লাহ তোমাদের দিয়েছেন।”
প্রিয় নবির (সা) এই ছোট্ট অনুরোধ কেই-বা ফেলতে পারে? সাহাবিদের মধ্যে যারা কাফেলা থেকে আবুল আসের সম্পদের অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা তাঁকে তা ফেরত দিতে উদ্যত হলেন। কিন্তু ফেরত দেওয়ার আগে তাঁরা বললেন, “হে আবুল আস, আপনি তো নবিজির (সা) জামাতা। এখনও কি আপনার সময় হয়নি ইসলাম গ্রহণ করার? আপনি যদি তা করেন, তাহলে আমরা আপনাকে আপনার সমুদয় অর্থ ফেরত দেব এবং আপনি মদিনায় থাকতে পারবেন। “

অর্থ ফেরত দেওয়ার বিনিময়ে, অর্থাৎ অনেকটা ঘুষ দিয়ে তাকে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত করার এই চেষ্টাটি আবুল আসের ভালো লাগল না। তিনি বললেন, “এই জন্য (অর্থের লোভে) আমি আমার ধর্মবিশ্বাস পরিবর্তন করব? এ তো বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। এ তো জঘন্য ব্যাপার।” আবুল আসের এই প্রতিক্রিয়ায় সাহাবিরা আর দেরি না করে তাঁকে তাঁর সমুদয় সম্পদ ফেরত দিলেন। এখানে উল্লেখ্য, এই সম্পদ ছিল মক্কার লোকজনের কাফেলায় লগ্নি করা সম্পদ, শুধু আবুল আসের ব্যক্তিগত নয়।
আবুল আস অর্থ নিয়ে মক্কায় ফিরে গেলেন। তারপর প্রত্যেক মালিককে তাদের প্রাপ্য অংশ বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, “আমার কাছে কি তোমাদের কারও আরও কিছু পাওনা আছে?” সবাই বলল, “না। আপনি আপনার দায়িত্ব চমৎকারভাবে পালন করেছেন।” আবুল আস সব কাজ দ্রুত শেষ করে মক্কার কুরাইশদের সামনেই শাহাদা পড়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি মদিনায় অবস্থানকালে তা করতে চাননি, কারণ তাতে কেউ বলতে পারত যে, তিনি টাকার জন্য অথবা জীবন বাঁচানোর জন্য ইসলাম গ্রহণ করেছেন।
আবুল আসের পিতামহ আবদ শামস ছিলেন কুরাইশদের গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তিত্ব। মক্কায় তাঁর বিন্দুমাত্র ক্ষতি করার মতো কেউ ছিল না। তাই আবুল আস কাবাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে শাহাদা পড়ার মতো সাহস দেখাতে পেরেছেন। মুসলিম হয়ে তিনি মদিনায় ফিরে আসেন এবং জয়নবের সঙ্গে আবার মিলিত হন।
এই কাহিনির ফিকহ-সংক্রান্ত দুটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন:
১. আবুল আসকে যখন বন্দি করা হয়, তখন তিনি স্পষ্টতই মুসলিম ছিলেন না। নবিজি (সা) তাঁকে মূলত এই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে ছেড়ে দেন যে তাঁরা (আবুল আস ও জয়নব) তখনও বিবাহিত অবস্থায় ছিলেন। আবার তিনি জয়নবকে একথাও বলেছিলেন, আবুল আস মুশরিক। তাই সে আর জয়নবের স্ত্রী হিসেবে থাকতে পারে না।” তাহলে কি তখন তাঁদের বৈবাহিক সম্পর্ক অটুট ছিল?
২. আবু দাউদ, তিরমিজি, আল-নাসাই ইত্যাদি গ্রন্থের একটি সহিহ হাদিস অনুসারে, আবুল আস মদিনায় ফিরে এলে নবিজি (সা) দেনমোহর (অর্থাৎ নতুন করে নিকাহ) ছাড়াই তাঁকে জয়নবের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ফিকহের দিক থেকে দেখলে বিষয়টি সমস্যাপূর্ণ। কারণ, আমরা জানি, স্ত্রী ইসলাম গ্রহণ করার পর ইদ্দতকালীন সময়ের (এক মাসের) মধ্যে স্বামীও ধর্মান্তরিত না হলে বিয়ে বাতিল হয়ে যায়। অধিকাংশ পণ্ডিতের মতে, স্বামী যদি এক মাস সময় পেরোবার পরে ধর্মান্তরিত হয়, তাহলে স্ত্রীকে আবার দেনমোহর দিয়ে নতুনভাবে নিকাহ করতে হবে। কিন্তু এখানে আমরা দেখছি, নবিজি (সা) আবু আল আসকে জয়নবের কাছে কোনো দেনমোহর ছাড়াই ফিরে যেতে দিয়েছেন। আমরা এই দুটি বিষয় কীভাবে সমন্বয় করব?
আরও পড়ুনঃ
